সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো

সনদ আইন (1813) | সনদ আইনের উদ্দেশ্য | সনদ আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো

উত্তর:
সনদ আইন (1813)
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পাশ্চাত্য বণিকরা এদেশে আসার পরে মিশনারীরা এদেশে আসেন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। মিশনারীরা দেশীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে খ্রিস্ট ধর্মের বাণী ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের প্রচার করা শুরু করেন দেশের জনসাধারণের মধ্যে। 1765 খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। তবে ইংরেজরা মূলত ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানাের চেষ্টা চালায়। এই সময়ে ভারতবর্ষের শিক্ষার দায়িত্ব কোম্পানি গ্রহণ করবেন কিনা সে বিষয়ে কোম্পানির ডিরেক্টর এবং ভারতবর্ষে নিযুক্ত কোম্পানির আধিকারিকদের মধ্যে একটি মতপার্থক্য দেখা যায়। 1811 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকার যদি শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থ ব্যয় না করে তাহলে এদেশে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা লােপ পাবে। কোম্পানির এই শিক্ষা সম্বন্ধে ঔদাসীন্য ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সমাজ এবং ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারীদের দ্বারা তীব্রভাবে সমালােচনার সম্মুখীন হয়। 1813 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ আইন পুনর্নবীকরণ এর সময় সর্বপ্রথম কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই ভারতীয় শিক্ষার ভার কোম্পানির হাতে চলে যায়। 1765 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1813 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি হল হেস্টিংস -ডানকান চিন্তাধারা যা লর্ড মিন্টোর প্রস্তাবনা। যাকে বলা হয় প্রাচ্যবাদী চিন্তা ধারা। এবং দ্বিতীয়টি হল উইলবারফোর্স গ্রান্ট ও মিশনারি চিন্তাধারা বা পাশ্চাত্য বাদী চিন্তা ধারা। যার ফল সমাজে সুদূরপ্রসারী।

1) প্রাচ্যবাদীদের মতে: প্রাচ্যবাদী ভারতীয় প্রশাসকরা পাশ্চাত্য সভ্যতা তথা খ্রিস্টান চিন্তাধারা বিস্তারের পক্ষপাতিত্ব ছিলেন না। লর্ড মিন্টোর প্রস্তাবনা ছিল ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা। তিনি বলেছিলেন ভারতের নিজস্ব ধর্ম, নৈতিকতা, শিক্ষার মান এবং শিক্ষিতের সংখ্যা ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে এগােচ্ছে। এর পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ এবং অর্থব্যয় বিশেষভাবে প্রযােজন। একইসঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারীদের নিরুৎসাহিত করার পক্ষপাতী ছিলেন কারণ তা না হলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি বজায় রাখা সম্ভব নয়।  

2) পাশ্চাত্যবাদীদের মতে : পাশ্চাত্য বাদী অর্থাৎ উইলিয়াম ফোর্ট এবং খ্রিস্টান মিশনারীরা বিশ্বাস করতেন যে ইংরেজি ভাষা এবং খ্রিস্টান ধর্মের নীতি অনুযায়ী শিক্ষাদান হবে সর্বশেষ্ঠ শিক্ষা এবং তারা চেয়ে ছিলেন এদেশে শিক্ষা দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হােক। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোম্পানির সরকারকে ব্যয় করতে হবে। লর্ড ওয়েলেসলি পাশ্চাত্য বাদীদের মতকেই সমর্থন জানান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের এইরকম মতবিরােধের মধ্যেই লর্ড মিন্টোর প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে 1813 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হয়। যা 1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্ট নামে পরিচিত। 

সনদ আইন 1813 এর উদ্দেশ্য:
1) সনদ আইনের 13 নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল, ভারতবর্ষের মধ্যে প্রয়ােজনীয়জ্ঞানের বিস্তার ও তাদের নৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা প্রবর্তনের আগ্রহী যে কোন সংস্থা বা ব্যক্তি ভারতবর্ষে যেতে পারবে ও সেখানে থাকতে পারবে তাদের সব ধরনের সুযােগ-সুবিধা প্রদান করা হবে।  

2) মিশনারিদের ওপর কোম্পানির যে বিধি নিষেধ ছিল তা উঠে যাওয়ার ফলে মিশনারীরা স্বাধীনভাবে শিক্ষা দেওয়ার অধিকার পায়। এই কারণে একটি ধারাকে ‘মিশনারি ধারা’ বলা হয়।

3) সনদ আইনের 43 নম্বর ধারায় বলা হয়, ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষের সামরিক, অসামরিক ও শিল্পবাণিজ্যের খরচ বহন করার পরে রাজস্ব কর ও লাভের আয় থেকে যে পরিমাণ উদবৃত্ত হবে তা থেকে অন্ততপক্ষে প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা ব্যায় করতে হবে। 

4) শিক্ষিত ভারতীয়দের উচ্চ শিক্ষালাভে উৎসাহিত করার জন্য, সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নের জন্য এবং ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রবর্তন ও উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হবে। সনদ আইনের এই ধারাটি ‘শিক্ষা বিষয়ক’ ধারা নামে পরিচিত।

1813 সালের সনদ আইন ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। যার ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ পায়। 

1) সনদ আইনে মিশনারীরা শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। ফলে শিক্ষায় ধর্মীয় বিষয়ের প্রাধান্য পায়, স্বাধীন ভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পুস্তক প্রকাশ, নারী শিক্ষার বিস্তার, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজ শুরু করে।

2) মিশনারিদের এই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার উদ্যোগকে বহু গুণীজন সমর্থন করেছিলেন। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও মিশনারীদের এই উদ্যোগকে পুরােপুরি সমর্থন করেছিল। সেই কারণে কোম্পানি অধিকৃত রাজ্য গুলিতে মিশনারীরা ধর্ম প্রচার ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার শুরু করেছিল।

3) চার্টার অ্যাক্ট এর 43 নম্বর ধারায় ভারতীয় শিক্ষার জন্য যে অর্থ ব্যয় করার কথা বলা হয় তা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এর ফলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই সময় সমাজের কিছু বিশিষ্টজন মনে করেন প্রাচ্য শিক্ষার প্রসারের থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে জন্য অর্থ মঞ্জুর করা প্রয়োজন। এর মধ্য দিয়ে ভারতবাসীদের মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানের বিস্তার ঘটবে। 

4) এই আইন প্রবর্তন হওয়ায় আংশিক হলেও ভারতীয়দের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অধীনে যায়। এর আগে পর্যন্ত শিক্ষা বেসরকারি পরিচালনাধীন ছিল। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে সনদ আইন এর ফলে শিক্ষা প্রসারে বছরে এক লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ভারতীয়দের জন্য বছরে এক লক্ষ টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করার বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়।

5) এই সনদ আইন এর দ্বারা গ্রান্ট ও উইলবারফোর্সের আন্দোলনের সমাপ্তি হয়েছিল। কোম্পানি ভারতীয় শিক্ষার প্রসারে এক লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য শুরু করেন। এর দ্বারা বলা যায় 1813 সালের সনদ আইন ভারতে শিক্ষার ইতিহাসে এক পুরানাে যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছিল। 

6) সনদ আইনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এটি ভারতের জাতীয় শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। কারণ সনদ আইন পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচার এর জন্য ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে সরকারি স্বীকৃতি দেয়। 

7) এই আইনে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বপন করা হয়েছিল। কারণ মিশনারীরা শুধুমাত্র খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করত না তার সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদির মূল ভাব প্রচার করত।

8) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে সরকারি উদ্যোগকে যেমন কাজে লাগানাের কথা ঘােষণা করা হয়েছিল। তেমনি বিভিন্ন বেসরকারি প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার ব্যয় ভার বহনে আগ্রহী করে তােলা হয়েছিল। সবশেষে বলা যায়, 1813 সালের সনদ আইন ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এই আইনের ফলেই শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস প্রতিফলিত হয়।

Comments