ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

ডেভিড ইস্টনের ব্যবস্থা তত্ত্ব সম্পর্কে যা জান লিখ।

অথবা, সমালোচনাসহ ডেভিড ইস্টনের সিস্টেম তত্ত্বটি বর্ণনা কর।

অথবা, সমালোচনাসহ ডেভিড ইস্টনের ব্যবস্থা তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর৷৷ ভূমিকা : ব্যবস্থা তত্ত্বের উদ্ভব বহু পূর্বে ঘটলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে এ তত্ত্ব ছিল উপযোগী। বর্তমান সময়েও সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে এ তত্ত্বের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘The Political System’ গ্রন্থে ইস্টর্ন এ তত্ত্ব

প্রয়োগ করেন। সামগ্রিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে সামনে রেখে এ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটানো হয়। তাই এ তত্ত্ব সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে সফলতার দাবিদার।

ডেভিড ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্ব (System theory of David Istern) : ব্যবস্থা তত্ত্বের সাথে ডেভিড ইস্টার্নের নাম সম্পর্কযুক্ত। তিনি কতকগুলো গ্রন্থের মাধ্যমে ব্যবস্থা তত্ত্বকে তুলে ধরতে সক্ষম হন। এক্ষেত্রে তাঁর ‘The

Political System’ (1953), ‘A Systems Analysis of Political Life’ (1965) এবং ‘A Framework for Political Analysis’ (1965) প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে বুঝিয়েছেন, “A political system, therefore, will be identified as a set of interactions, abstracted from the totality of social behaviour, through which values are authoritatively allocated for a society.”

ইস্টার্নের সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে তিনটি উপাদানের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা :

১. রাজনৈতিক ব্যবস্থা নীতির সাহায্যে জীবন উপকরণসমূহ বরাদ্দ করা,

২. এর বরাদ্দ কর্তৃত্বপূর্ণ এবং

৩. এরূপ কর্তৃত্বপূর্ণ বরাদ্দ সমাজের জন্য বাধ্যতামূলক। সমাজ ও পরিবেশ নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে মানুষ নতুন নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে। নতুন নতুন কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়। ইস্টর্ন তাঁর ব্যবস্থা তত্ত্বে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনশীল পরিবেশের মধ্যে কিভাবে টিকে থাকে তার বাস্তবভিত্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইস্টার্নের আলোচনায় রাজনৈতিক বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণে ইস্টর্ন চারটি উপাদানের উল্লেখ করেছেন। যথা :

১. ব্যবস্থা (System),

৩. সাড়া প্রদান (Response) ও

এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. ব্যবস্থা (System) : মানুষের সকল ধরনের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে ইস্টার্ন মানব আচরণের একপ্রকার ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো মানুষের সামাজিক আচরণের ভিত্তিতে সৃষ্ট পারস্পরিক ক্রিয়ার সমষ্টি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিষয় ইনপুট ও আউটপুট সম্পর্কিত আলোচনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের বিষয় জড়িত । ব্যবস্থার ধারণাটি কোন একক বা স্বতন্ত্র ধারণা নয়। এর সাথে উপব্যবস্থা ধারণাটিও সম্পর্কযুক্ত।

২. পরিবেশ (Environment) : পরিবেশ বিষয়টি উপব্যবস্থা ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সমাজে রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি যেসব উপব্যবস্থা থাকে তার সমন্বয়ে গড়ে উঠে পরিবেশ। ইস্টার্ন বলেছেন, “পরিবেশ বলতে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সে অংশকে বুঝায়, যে অংশ রাজনীতি ব্যবস্থার সীমানা বহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও একই সমাজের

অভ্যন্তরে অবস্থান করে।”

২. পরিবেশ (Environment),

৪. ফিডব্যাক (Feedback)।

এভাবে তিনি পরিবেশকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন । যথা :

2.সমাজের অভ্যন্তরস্থ পরিবেশ : রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে সমাজের মধ্যে বিরাজ করে সে সমাজের অন্যান্য উপব্যবস্থার সমন্বয়ে পরিবেশের সমাজ অভ্যন্তরস্থ দিকটি গড়ে উঠে।

iii. সমাজ বহির্ভূত পরিবেশ : যেখানে সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, জৈবিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ব্যক্তিত্ব ব্যবস্থা ইত্যাদি অন্যান্য উপব্যবস্থার অন্তর্গত। অপরপক্ষে, সমাজ অভ্যন্তরস্থ উপাদানসমূহ ছাড়া অন্য কোন সমাজের উপাদানের সমন্বয়ে সমাজ বহির্ভূত দিকটি গড়ে উঠে।

৩. সাড়া প্রদান (Response) : ইস্টা র্নের মতে, “রাজনৈতিক ব্যবস্থা একপ্রকার স্বনিয়ন্ত্রিত ও সাড়া প্রদানকারী

ব্যবস্থা।” এর দুটি কারণ হলো :

এ ব্যবস্থা স্বীয় পরিবেশের সাথে সংগতি বজায় রেখে চলার দক্ষতাসম্পন্ন এবং পরিবেশে কোন পরিবর্তন দেখা দিলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি মুক্ত ব্যবস্থা । যার ফলে পরিবেশের পরিবর্তনে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসে।

৪. ফিডব্যাক (Feedback) : রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নির্ভর করে ইনপুট ও আউটপুটের সমতার উপর। তাই রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন ইনপুট ও আউটপুটের সমতা বিধান। ফিডব্যাক এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সমতা বিধান করে। ইস্টার্নের মতে, ফিডব্যাক একটি যোগাযোগ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার আউটপুট পরিবেশে কি প্রভাব ফেলে বা পরিবর্তন করে তা ইনপুট আকারে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে।

ডেভিড ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্বের সমালোচনা (Criticism in David Istern’s system theory) : রাজনৈতিক চিন্তাজগতে ডেভিড ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্ব ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এর বেশকিছু সমালোচনা লক্ষ্য করা

যায়। এর বেশকিছু সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. গতানুগতিক : অধিকাংশ তাত্ত্বিক ডেভিড ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্বটিকে গতানুগতিক তথা অভিনব তত্ত্ব নয় হিসেবে অভিহিত করেছে। সমাজতাত্ত্বিক লিপসন. বলেন, ব্যবস্থা তত্ত্বে পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ নতুন কিছু নয়। তাছাড়া দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখ এ তত্ত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

২. যান্ত্রিকতা : অনেক তাত্ত্বিক ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্বকে যান্ত্রিক হিসেবে সমালোচনা করেছেন। কারণ এটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কেবল ইনপুট ও আউটপুট প্রবাহের মতো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

৩. রক্ষণশীল প্রকৃতির : ডেভিড ইস্টার্নের ব্যবস্থা তত্ত্বের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এর রক্ষণশীলতা। সাধারণত রাষ্ট্রের কুঁজোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা এ তত্ত্বের প্রধান লক্ষ্য। তাছাড়া একটি ব্যবস্থা কিভাবে তার

পরিবেশের পরিবর্তিত অবস্থার মধ্যেও নিজেকে রক্ষা করতে পারে তা এ তত্ত্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

৪. সংকীর্ণতা : ইস্টার্ন ব্যবস্থা তত্ত্বে ইনপুট ও আউটপুটের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যে, তিনি রাজনৈতিক কাঠামো ও তার সমস্যা সম্পর্কিত আলোচনায় মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নি। ফলে তাঁর আলোচনা সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল বলে অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যবস্থা তত্ত্ব হলো এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে একটি বিষয়কে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণে ব্যবস্থা তত্ত্ব ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে সমাজ ও সমাজের রাজনীতি বিবেণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ তত্ত্বের কতিপয় সীমাবদ্ধতা থাকলেও সমাজের বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণে খুবই ফলপ্রসূ এবং বাস্তবানুগ ।