প্রশ্ন – ভারতের ইতিহাসে সুলতানা রাজিয়া ও নূরজাহানের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।

প্রশ্ন – ভারতের ইতিহাসে সুলতানা রাজিয়া ও নূরজাহানের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।

উত্তর:–

★ সুলতানা রাজিয়া– ভারত ইতিহাস তথা সমগ্র মুসলিম জাতির ইতিহাসে সুলতানা রাজিয়া একটি স্মরণীয় নাম। যে-সমস্ত নারী ভারত ইতিহাসে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন; তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুলতানা রাজিয়া। মধ্যযুগ তথা সুলতানি আমলের ইতিহাসে রাজিয়া ছিলেন প্রথম মহিলা শাসক। মধ্যযুগের ধর্ম-প্রভাবিত সমাজে একজন মুসলিম নারীর সিংহাসন লাভ ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা।

★ সিংহাসন লাভ– দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর জীবদ্দশায় কন্যা রাজিয়াকে দিল্লি সুলতানির উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেও ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর দিল্লির গোঁড়া উলেমা শ্রেণি ও আমির-ওমরাহরা ইলতুৎমিসের অপদার্থ পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু অযোগ্য ও অপদার্থ রুকনউদ্দিন ফিরোজের বিরুদ্ধে দল্লির আমির-ওমরাহদের মনে শীঘ্রই ক্ষোভ জমা হতে থাকে। শেষপর্যন্ত কতিপয় আমির-ওমরাহদের সাহায্যে রুকনউদ্দিনকে সিংহাসনচ্যুত করে রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তিনি ১২৩৬ খ্রীঃ থেকে ১২৪০ খ্রীঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

★ সমস্যা ও সমাধান– দিল্লির সুলতানি সিংহাসনে বসেই রাজিয়া বিভিন্ন সমস্যার সন্মুখীন হন। যেমন–

(১) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী (ওয়াজির) ও রাজিয়া-বিরোধী চল্লিস চক্রের অন্যতম নেতা মালিক মহম্মদ জুনাইদি রাজিয়ার সিংহাসন লাভের বিরোধীতা করেন।
(২) মুলতান, বদাউন, হানসি, লাহোর প্রভৃতি প্রদেশের আঞ্চলিক শাসনকর্তারা দিল্লি অবরোধ করে রাজিয়ার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলেন।

   ‌‌‌‌‌‌ এরূপ পরিস্থিতিতে রাজিয়া সুস্থ্য মস্তিস্কে সমস্যা সমাধানের দিকে অগ্রসর হন–
(১) চল্লিস চক্রের প্রভাব খর্ব করার জন্য একটি অতুর্কি গোষ্ঠী গঠনে তৎপর হন। তিনি অতুর্কিদের উচ্চপদ দেন।
(২) বিদ্রোহী আমির ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মধ্যে সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করেন।
(৩) বিরোধী কবির খান, ইজ্জুদ্দিন, মহম্মদ সালারি প্রমুখকে তিনি নিজ পক্ষে আনতে সক্ষম হন।
(৪) সুলতানা রাজিয়া মহম্মদ জুনাইদিকে পলাতক অবস্থায় নিহত করেন।

         ফলে সাময়িকভাবে হলেও সুলতানা রাজিয়া নিজের সিংহাসন কণ্টকমুক্ত করে প্রশাসনকে শক্ত করেন।

★ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ– সিংহাসনে বসেই রাজিয়া কেন্দ্রীয় শাসনকে সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গ্রহন করেন। তিনি–
(১) সুলতানা রাজিয়া তুর্কি অভিজাতদের নিয়ে গঠিত 'চল্লিস চক্র' ভেঙ্গে দেন।
(২) শাসন পরিচালনার জন্য একটি নিজস্ব অনুগত গোষ্ঠী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
(৩) মুহাজবুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং কুতুবউদ্দিন হাসান ঘুরিকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ করেন।

★ অভিজাতদের বিরোধীতা– দিল্লির গোঁড়া মৌলবি ও তুর্কি অভিজাতশ্রেণি বিভিন্ন কারনে রাজিয়ার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এগুলি হল– 
(১) রাজিয়া অশ্বরোহণ, অস্ত্রচালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য সরবরাহ, পুরুষের বেশে রাজসভা ও শাসনকার্য পরিচালনা প্রভৃতি মধ্যযুগীয় গোঁড়া উলেমা ও অভিজাতরা মেনে নিতে পারেন নি।
(২) রাজিয়া তুর্কি অভিজাতদের 'চল্লিস চক্র' ভেঙ্গে দিলে অভিজাতরা ক্ষুব্ধ হন।
(৩) প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে অতুর্কিদের নিয়োগ করেও তুর্কি অভিজাতদের অসন্তুষ্ট করেন।
 
        ফলে তারা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার উদ্যোগ নেয়।

★ আলতুনিয়া বিদ্রোহ– রাজিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র অভিজাতদের নেতা বলবন সৈন্যাধক্ষ আইতেগিনের সহায়তায় ভাতিন্ডার শাসনকর্তা আলতুনিয়া রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। রাজিয়া বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনাপতি ইয়াকুৎ খাঁকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হন। আলতুনিয়া এই যুদ্ধে ইয়াকুৎ খাঁকে নিহত করেন এবং রাজিয়াকে বন্দি করেন। সেই সময় রাজিয়ার ভাই বাহরাম শাহকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষনা করা হয়।

★ রাজিয়ার পতন– বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিবাহ করেন। বাহরাম শাহ রাজিয়ার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠান। বাহরাম শাহের ষড়যন্ত্রে রাজিয়া ও আলতুনিয়া উভয়েই নিহত হন। 

★ কৃতিত্ব– সুলতানা রাজিয়া যে প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। সমকালীন ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন সিরাজের মতে, রাজিয়া ছিলেন বুদ্ধিমতী, ন্যায়পরায়ণা, দয়ালু, বিদ্যোৎশাহিনী, প্রজাবৎসলা ও সমরকুশলা। ভারতে সুলতানি তথা মুসলিম শাসকদের মধ্যে রাজিয়াই ছিলেন একমাত্র নারী শাসক। মধ্যযুগের একজন নারী হয়েও তাঁর স্বল্পকালের রাজত্বকালে তিনি যে শাসন দক্ষতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও মানবিক অনুভূতির পরিচয় দিয়েছিলেন তা এক কথায় অনন্য।

★ নূরজাহান– মোগল আমলে একজন ব্যতিক্রমী নারী ছিলেন নূরজাহান। কখনো কখনো অতিসাধারণ মানুষ ভাগ্যের সহায়তায় উন্নতির চরমে পৌঁছান। মোগলযুগে ভারতে নূরজাহানের উত্থান তেমনি একটি কাহিনী। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাঁর এই পত্নী যে দৃঢ়তার সাথে প্রশাসনিক হাল ধরেছিলেন, তা আজও সকলকে বিস্মিত করে তোলে।

★ নূরজাহানের পরিচয়– নূরজাহান ছিলেন পারস্যের বাসিন্দা মীর্জা গিয়াস বেগ-এর কন্যা। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মেহেরউন্নিসা। মির্জা গিয়াস বেগ ভারতে এসে শেখ মামুদ নামে এক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের সহায়তায় আকবরের রাজপ্রসাদে চাকুরি গ্রহন করেন। পিতার সুত্র ধরেই কন্যা মেহেরউন্নিসাও আকবরের রাজপ্রাসাদে আসেন।

★ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহ– আকবরের পুত্র সেলিম (জাহাঙ্গীর) মোগল প্রাসাদে মেহেরউন্নিসাকে দেখে তাঁর রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে যান। সেলিম তাঁকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু আকবর তা মেনে নেন নি। তাই আকবর ১৭ বছরের মেহেরউন্নিসাকে তড়িঘড়ি বর্ধমানের জায়গিরদার আলিকুলি বেগের সঙ্গে বিবাহ দেন(1594)। কিন্তু পরবর্তীকালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে যুবরাজ সেলিম আলিকুলি খানকে হত্যা করেন এবং ১৬১১ খ্রীঃ মেহেরউন্নিসাকে বিবাহ করেন। তিনি তাঁর ১২ জন বেগমের মধ্যে তাঁকে প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর প্রিয়তমা পত্নীর নতুন নাম রাখেন নূরজাহান, যার অর্থ হল 'জগতের আলো'।

★ প্রশাসনে আধিপত্য– নূরজাহান ছিলেন প্রজাদরদি এবং বহুমূখী গুণের অধিকারী। রাজনৈতিক কৌশলে তিনি ১৬১১ খ্রীঃ থেকে ১৬২৭ খ্রীঃ পর্যন্ত মোগল প্রশাসনে সীমাহীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে নূরজাহান ছিলেন প্রশাসনের প্রধান নিয়ন্ত্রক এবং তাঁর নির্দেশেই মোগল প্রশাসন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই সময় নূরজাহান দর্শনার্থীদের দর্শন দিতেন এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁর ভাই আসফ খাঁ এর কন্যা আর্জমন্দ বানু বেগমকে (মমতাজ) যুবরাজ খুররম (শাহজাহান)-এর বিবাহ দেন।

★ নূরজাহান চক্র– জাহাঙ্গিরের অসুস্থ্যতা ও অন্ধ পত্নীপ্রেমের সুযোগে উচ্চাকাঙ্খী নূরজাহান তাঁর নিকটজনদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। যা 'নূরজাহান চক্র' নামে পরিচিত। তার নেতৃত্বাধীন এই চক্রের অনন্য সদস্যরা ছিলেন তাঁর পিতা মীর্জা গিয়াস বেগ, ভ্রাতা আসফ খাঁ, ইদমৎ খাঁ ও যুবরাজ খুররম (শাহজাহান) প্রমূখ। জাহাঙ্গিরের দুর্বলতার সুযোগে মোগল প্রশাসন ও রাজনীতিতে নূরজাহান চক্রের কর্তৃত্ব চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। নূরজাহান সিংহাসনের চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

★ পরিণতি– শেষপর্যন্ত নূরজাহান চক্রে ভাঙন ধরে। নূরজাহান তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলি বেগমকে জাহাঙ্গিরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ার বিবাহ দিয়ে শাহরিয়াকে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর পরিকল্পনা করেন। ফলে ক্ষুব্ধ খুররম নূরজাহানকে ক্ষমতাচ্যুত এবং পিতা জাহাঙ্গিরকে বন্দি করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। এর ফলে নূরজাহানের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে নূরজাহান খুররমের অধিনে গৃহবন্দি হয়ে জীবন কাটাতে বাধ্য হন। অবশেষে ১৬৪৫ খ্রীঃ (১৭ ডিসেম্বর) নূরজাহানের মৃত্যু হলে লাহোরের শাহোরের শাহদারাবাগে জাহাঙ্গিরের কবরের পাশেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়।

★ কৃতিত্ব– নূরজাহানের প্রধান কৃতিত্বগুলি হল– 
(১) নূরজাহান অতিসাধারণ অবস্থা থেকে মোগল রাজক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হন। 
(২) মধ্যযুগের একজন নারী হয়েও রাজনৈতিক বিচক্ষনতার ক্ষত্রে তিনি বহু পুরুষকেও হার মানান।
(৩) জাহাঙ্গিরের আমলে সাম্রাজ্যে অপশাসনের যে সম্ভবনা দেখা দিয়েছিল তা নূরজাহান নিজের যোগ্যতায় দূর করে দেশে সুশাসন প্রবর্তন করেন।

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.