কার্ল মার্কস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ | কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা

ভূমিকা: মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। বলাবাহুল্য, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হল মার্কসবাদের প্রধান ভিত্তি বা ইমারত। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এর সাহায্যে কার্ল মার্কস মানব সমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বৈজ্ঞানিক দার্শনিক বীশ্ববীক্ষা রূপে অভিহিত করা হয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মধ্যে মার্কসীয় দর্শনের তাত্ত্বিক ভিত্তি নিহিত রয়েছে।

দুটি পরস্পরবিরােধী শক্তির সংঘাতজনিত প্রক্রিয়াকে দ্বন্দ্ববাদ (Dialectics) বলা হয়। হেগেল প্রথম দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু হেগেল ভাববাদী দার্শনিক হওয়ায় মার্কস ফয়েরবাখের কাছ থেকে বস্তুবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হন। হেগেলের দ্বন্দ্ব ও ফয়েরবাখ এর বস্তুবাদী চিন্তার সংমিশ্রণে মার্কস তাঁর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ রচনা করেন। এই বিষয়টিকে সমর্থন করে মরিস কর্নফোর্থ বলেছেন, বস্তুবাদ একটি যুক্তিতর্কহীন বদ্ধমূল ধারণা নয়, বরং এটি হল প্রতিটি প্রশ্নকে বিচার বিশ্লেষণ অনুধাবন ও ব্যাখ্যার একটি উপায়।

উৎপত্তি: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Dialectical Materialism। ইংরেজি Dialectics শব্দটি এসেছে Dialego থেকে।

অর্থ: Dialectics বা দ্বন্দ্ব কথার অর্থ হল আলােচনা বা তর্কবিতর্ক বা বিতর্কের মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।

ব্যাপক অর্থ: ব্যাপক অর্থে দ্বান্দ্বিকতার অর্থ হল দুটি পরস্পরবিরােধী শক্তির সংঘাত, এই সংঘাত থেকে নতুন শক্তির উদ্ভব হয়।

দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের জনক: কার্ল মার্কস হলেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের জনক। কার্ল মার্কস মনে করেন বস্তু সত্য। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ কার্ল মার্কস স্বীকার করে নিলেও সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মার্কস হেগেল কে অনুসরণ করেননি। তিনি দ্বন্দ্বাদের শাঁস (Rational karnel) নিয়েছেন তার খােলস নেননি। তিনি নিজেই তার 'দাস ক্যাপিটাল' (Das Kapital) গ্রন্থে লিখেছেন যে, "My dialectics is opposite to Hegel's"!

মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথাকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। একটি হল অচেতন অংশ, যার মূল কথা হল বস্তু এবং অপরটি হল সচেতন অংশ, যার মূল কথা হল মন বা ভাব। কিন্তু বিপরীতে হেগেলীয় দর্শনের মূল কথা, মনই হল আদি সত্তা এবং বস্তু হল গৌণ। কার্ল মার্কস হেগেলের কাছে ঋণ স্বীকার করে হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে পরিণত করেছেন।

কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে বিরােধের বীজ বর্তমান। একইসঙ্গে পরস্পরবিরােধী শক্তি (পজিটিভ ও নেগেটিভ) নিহিত থাকে। এর একটিকে বলা হয় বাদ (Thesis) অপরটিকে বলা হয় প্রতিবাদ (Antithesis)। উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে উন্নততর এক অবস্থার জন্ম হয় যাকে বলা হয় সম্বাদ (Synthesis)। পুরােনাে থেকে যখন নতুনের আবির্ভাব ঘটে তখন নতুন, পুরােনাের চাইতে গুণগত দিক থেকে উন্নত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। তবে সম্বাদ যে নতুন অবস্থার জন্ম দিল তার মধ্যেও অর্থাৎ সেই নতুনের মধ্যেও বাদ (Thesis) প্রতিবাদ (Antithesis) নামক উপাদান উপস্থিত থাকে, ফলে আবার দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হয়, জন্ম নেয় আরও এক নতুন সম্বাদ (Synthesis)।

ইতিহাসে দেখা যায় দাস সমাজ থেকে (দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় দাসমালিক ও ক্রীতদাস-এর লড়াই-এর ফলে) জন্ম নিয়েছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ আবার সামন্ততান্ত্রিক সমাজ (সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাস-এর দ্বন্দ্ব) থেকে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় নতুন করে জন্ম নিয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ। এইভাবে স্বীকার-অস্বীকারের পর্ব চলতেই থাকে। বলা যায় এ খেলা চলছে নিরন্তর এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি (Negation of Negation) যা গতিশীল।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মৌলিক সূত্র: মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তিনটি মৌলিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এই সূত্রগুলি হল一

বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব,
পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন এবং
নেতির নেতিকরণ বা অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি।
কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূলসূত্র: মার্কসবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কার্ল মার্কসের দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল এই জগৎ বস্তায়। জগতের প্রতিটি বস্তু পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং এই বস্তুজগৎ অনড় বা অচল নয়, তা সর্বদা পরিবর্তনশীল। প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরােধী ধর্ম বিদ্যমান থাকে, সেগুলি হল বাদ (Thesis), প্রতিবাদ (Anti thesis) এবং সম্বাদ (Synthesis)। মার্কসের মতে, উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের জন্যই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাে পরিবর্তিত হয়।

সমালােচনা: কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে। যেমন- বস্তু ছাড়া যে সমাজ পরিবর্তনের ধরন, ক্ষমতার লােভ বা কোনাে মনীষীর আবির্ভাবও ইতিহাস পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারে, কার্ল মার্কস এইসকল উপাদানকে অবহেলা করেছেন বলে সমালােচকরা মনে করেন। তা ছাড়া কার্ল মার্কসের বিপ্লব সম্পর্কে বা উন্নত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবায়িত হয়নি এবং শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশে ও বিপ্লব হয়নি।

উপসংহার : পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক মূল্য ও গুরুত্ব আজও অপরিসীম। তাই ক্যারিউ হান্ট-এর মতে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের স্রষ্টা হলেন কার্ল মার্কস। কেননা কার্ল মার্কসের পূর্বে আর কোনাে রাষ্ট্র দার্শনিক ও চিন্তাবিদ শ্রেণিশাসন, শ্রেণিশােষণ এবং সমাজ পরিবর্তনের ডাক দেননি। তাই বলা যায় যে, মার্কসের দ্বন্দ্ববাদ কে অস্বীকার করার অর্থ হল বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করা। তাই মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক দর্শন। মরিস কর্নফোর্থ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ কর্ম বা প্রয়ােগের দর্শন বলে চিহ্নিত করেছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। এমিল বার্নসের মতে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই তত্ত্ব অতীত ও বর্তমানে অন্তর্দ্বন্দ্বের আলােয় মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারার পর্যালােচনা করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.