রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা | রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা

রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা | রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা

অস্তিত্বও অস্বীকার করা যায় না। বলা হয় যে, বনিয়াদ থেকে উপরি-কাঠামো আপেক্ষিকভাবে স্বাধীন। মার্কস আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য এবং আভ্যন্তরীণ নির্ভরশীলতা ও বাহ্যিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন। উপরি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত কোন কোন উপাদান নির্দিষ্ট সামাজিক বনিয়াদের মধ্যে সৃষ্ট হয়েছে, অথচ পরবর্তীকালের সামাজিক বনিয়াদের মধ্যেও তার অস্তিত্বকে স্থায়ীভাবে বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ধর্মীয় উপরি-কাঠামোর কথা বলা যায়। তেমনি আবার বনিয়াদ থেকে সৃষ্ট এমন সব উপাদান উপরি-কাঠামোর মধ্যে থাকে যা বনিয়াদের সঙ্গে বিরোধিতার সম্পর্কযুক্ত। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। এই আর্থনীতিক বনিয়াদের থেকেই সৃষ্টি হয় পরস্পর বিরোধী রাজনীতিক ও মতাদর্শগত উপরি-কাঠামোর। পুঁজিবাদী সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদের উপর গড়ে উঠে বুর্জোয়া রাষ্ট্র, বুর্জোয়া মতাদর্শ ও অন্যান্য বুর্জোয়া উপরি-কাঠামো এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারীয় মতাদর্শ, প্রলেতারীয় রাজনীতিক সংগঠন প্রভৃতিও গড়ে উঠে।

রাষ্ট্রের মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা:
রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার স্বাতন্ত্র্যের ধারণাকে মিলিবাগু আর এক দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে বুর্জোয়া শ্রেণী পরস্পর-বিরোধী বিবিধ উপাদান নিয়ে গঠিত। বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন অংশ থাকে। এই সমস্ত অংশের স্বার্থ ও বিষয় সব সময় অভিন্ন প্রকৃতির নয়। বুর্জোয়া শ্রেণীর এই সমস্ত অংশের সঙ্গে সাধারণ বিষয় যেমন থাকে, তেমনি আবার প্রত্যেক অংশের স্বতন্ত্র্য বিষয় বা নির্দিষ্ট বিষয় থাকে। এ রকম ক্ষেত্রে মধ্যস্থতামূলক ভূমিকা এবং সামঞ্জস্য সাধনের দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্র। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই ভূমিকা পালন রাষ্ট্রকে সক্ষম করে তোলার জন্য শাসকশ্রেণীর বা প্রাধান্যকারী শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে পউলানটাসের অভিমত:
কাঠামোবাদী (Structuralist) দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পউলানটাস (Poulantzas)-এর Political Power and Social Classes শীর্ষক রচনায় আলোচনা আছে। কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বুর্জোয়া শ্রেণীর নির্দিষ্ট সদস্য ও স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রের স্বাধীন অবস্থানই হল রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার। পউলানটাস বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়াদের মধ্যেই বিভিন্ন রকমের আর্থ-রাজনীতিক স্বার্থের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ বুর্জোয়ারা অভিন্ন প্রকৃতির বা সমজাতীয় শ্রেণী হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। বুর্জোয়াশ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন অংশ থাকে। এর যে কোন একটির নেতৃত্বাধীনে ক্ষমতা-জোটের সৃষ্টি হতে পারে। এবং এই ক্ষমতা জোটের মধ্যেই একাধিক শ্রেণী-চক্র থাকতে পারে এবং বাস্তবে থাকে। এই শক্তি জোটের মূল উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়াশ্রেণীর দীর্ঘকালীন স্বার্থ সংরক্ষণ। তবে শ্রমিকশ্রেণীর মানুষকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। এ বিষয়ে উল্লিখিত শক্তি জোটের সামর্থ্য যথেষ্ট নয়, সীমাবদ্ধ। এ রকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট স্বার্থ সংরক্ষণে একমাত্র রাষ্ট্রই সক্ষম। আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে।

রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কে বুরলাস্কির অভিমত:
রাষ্ট্রের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি নিম্নে আধুনিককালের মার্কসবাদীরাও আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে ফাইওডোর বুরলাস্কি (Fyodor Burtalsky) তাঁর The Modern State and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা তাঁর অভিমত অনুযায়ী সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য্য উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব ও কার্যাবলী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে রাষ্ট্রকে প্রায়শই হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যাবলী বৃদ্ধি পেয়েছে। বুরলাস্কির মতানুসারে বুর্জোয়া রাষ্ট্রসমূহের শ্রেণী-চরিত্র বিশেষ ধরনের। এই শ্রেণীচরিত্রের মধ্যেই নিহিত আছে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি প্রসারিত হওয়ার মূল কারণ। রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিকাশ; উৎপাদনের সামর্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি; সামাজিক ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি প্রভৃতিও রাষ্ট্রের কাজকর্মের এলাকাকে সম্প্রসারিত করেছে। এই সমস্ত কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের স্বার্থে রাষ্ট্রের স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য সম্প্রসারিত হয়েছে। রাষ্ট্র বা সরকার সব সময় সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর নির্দেশক্রমে পরিচালিত হতে পারে না। কারণ কার্যক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিককালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর প্রভাব থাকে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রকে অনেকাংশে স্বাধীনভাবে সক্রিয় হতে হয়। তা ছাড়া আধুনিককালের সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিশেষভাবে জটিল প্রকৃতির। বিশেষজ্ঞ ব্যতিরেকে যে কোন ব্যক্তির পক্ষে এই প্রক্রিয়ার সামিল হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবতই বিদ্যমান সমাজ বহুলাংশে স্থিতিশীল প্রতিপন্ন হয়। তবে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য এতে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাম্প্রতিককালের অবস্থা: বুরলাস্কির অভিমত অনুযায়ী বর্তমানে বুর্জোয়া রাষ্ট্র শাসকশ্রেণীর কাছ থেকেও স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকারের সুযোগ পেয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে সমাজবিরোধী বিবিধ কাজকর্মে জনসাধারণের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই সমাজ পরিচালনা সম্পর্কিত কাজকর্ম অনেক ক্ষেত্রেই অতিমাত্রায় জটিল হয়ে পড়েছে। এ রকম পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়। এভাবেও রাষ্ট্রের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য সম্প্রসারিত হয়। সাম্প্রতিককালে জনপ্রশাসন ও সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারী কাজকর্ম থেকে বুর্জোয়া শ্রেণী বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বুরলাস্কি সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিপন্ন করেছেন যে, বর্তমানে মার্কিন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় সরকারী কর্মচারীর সংযোগ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশেও একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতার পরিণামে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু পশ্চিমী বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী দেশগুলিতেই নয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও অভিন্ন প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বিকাশশীল দেশগুলির সমাজব্যবস্থায় কোন বিশেষ একটি শ্রেণীকে প্রাধান্যকারী শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে একাধিক শ্রেণীকে ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামিল হতে দেখা যায়। তার ফলে শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র অধিকতর আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ পায়।

রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র সম্পর্কিত মূল্যায়ন:
মার্কসীয় তত্ত্বের রাষ্ট্রের হাতিয়ারগত ধারণা এবং রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের ধারণা একবারে বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা এ বিষয়ে বিবিধ সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। এ বিষয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্যগত অবস্থান সর্বাংশে সন্তোষজনক প্রতিপন্ন হয় নি। যাইহোক এ প্রসঙ্গে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক।

(১) রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্রের তত্ত্ব স্বীকার করে নিলে রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণা দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা-স্বাধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার সৃষ্টি হয়। এই কারণে মিলিবাও এক সময় বলেছেন যে, রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক তত্ত্ব এবং আপেক্ষিক স্বাধিকারের তত্ত্ব সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলসের আলোচনা অল্পবিস্তর অস্বচ্ছতার সৃষ্টি করেছে। কারণ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের স্বীকৃতি রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের ধারণাকে ভোঁতা করে দেয়। 

(২) মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য ভোগ করার সুযোগ পায় বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকারের বিষয়টি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কোন স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হিসাবে পরিগণিত হতে পারে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে বুর্জোয়াদের সামগ্রিক প্রাধান্যের ব্যবস্থা এক সময় অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়। সে রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের চরম অভিব্যক্তি ঘটে। রাষ্ট্র তখন প্রাধান্যকারী বুর্জোয়াদের হাতে শ্রেণী-শাসনের হাতিয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ তখন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণা বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অলীক প্রতিপন্ন হয়।

(৩) মিলিবাও চূড়ান্তভাবে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক ধারণা এবং রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণার মধ্যে তেমন কোন স্ব-বিরোধিতা নেই। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, সরকার প্রশাসক গোষ্ঠী গঠিত হয় প্রাধান্যকারী শ্রেণীর প্রতিনিধিদের নিয়ে। শাসক গোষ্ঠীকে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থারও স্বার্থ সংরক্ষণের সচেষ্ট হতে হয়। এই কারণে শাসক গোষ্ঠীর আপেক্ষিক স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য থাকা আবশ্যক।রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা


মার্কসীয় তত্ত্বের অংশবিশেষ: রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কিত ধারণা হল মার্কসীয় দর্শনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপেক্ষিক স্বাধীনতার আলোচনা রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদকে সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ করে তোলে। রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতহ্যের ধারণাটি মার্কসবাদী ব্যবস্থার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। মার্কস The Eighteenth Brumaire শীর্ষক রচনায় রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রের এই স্বাতন্ত্রের বিষয়টি সব সময় সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়, তা নয়। মিলিবান্ডের মতানুসারে রাষ্ট্রে আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণাটি হল গৌণ এবং মুখ্য হল রাষ্ট্রের হাতিয়ারগত (instrumentalist) ধারণা।



রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্রের ধারণা
মিলিবাও তাঁর Marxism and Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্যের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছেন। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত সংকট, আর্থনীতিক বিচারে প্রাধান্যকারী শ্রেণীর চাপ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে মিলিবাও রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতার বিষয়টি আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধিকার একটি বিশেষ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার মাত্রার উপর নির্ভরশীল। এই বিশেষ ক্ষেত্রটি হল জাতীয় স্বার্থে ক্ষমতার অধিকারীদের বা প্রয়োগকারীদের স্বার্থ কী উপায়ে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব বা করা হয়। এবং প্রধানত শাসকশ্রেণীকেই জাতীয় স্বার্থের ক্ষমতাধিকারী বলে মনে করা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শাসকশ্রেণীর হাতের একটি শোষণমূলক হাতিয়ার বিশেষ। রাষ্ট্র বলতে শ্রেণী-রাষ্ট্রকেই বোঝায়। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র সব সময়েই শাসক-শ্রেণীর নির্দেশ ক্রমেই পরিচালিত হয় এবং এর কোন রকম বা কিছুমাত্র স্বাতন্ত্র্য নেই। কার্যক্ষেত্রে অনেক সময়েই আইন, শাসন ও বিচার বিষয়ক কার্যাবলী সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র অনেকাংশে স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করে। মিলিবাণ্ডের মতানুসারে রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক (instrumental) ধারণার সঙ্গে স্বাধিকারমূলক ধারণা সর্বাংশে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ বিষয়ে মিলিবাগু বলেছেন: “The nation of the state as an instrument does not fit this fact, and tends to obscure what has come to be seen as an crucial property of the state."



রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধিকার-স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কিত বিষয়টি মোটামুটি তিনটি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আলোচিত হতে দেখা যায়। এই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি হল :

হেগেলীয় মার্কসীয় ঐতিহ্য (Hegelian (Marxian Tradition),

হাতিয়ারগত (instrumentalist) এবং

কাঠামোগত (structuralist)। 

হেগেলীয়-মার্কসীয় ঐতিহ্যের ধারণা অনুযায়ী জোর দেওয়া হয় মতাদর্শ ও সচেতনতার উপর। হাতিয়ারমূলক ধারণায় রাষ্ট্রকে শ্রেণীশাসনের যন্ত্র হিসাবে দেখা হয়। হাতিয়ারগত দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক যে কাঠামোর মধ্যে গড়ে উঠে, এই আলোচনায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। কাঠামোবাদীরা আলোচনা করেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে নীতি নির্ধারণের উপায়-পদ্ধতি। কাঠামোগত আলোচনায় রাষ্ট্রের হাতিয়ারমূলক প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা হয়।


Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.