নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো?
নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো?
উত্তর:- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে নবপ্রজন্মের উদারনীতিবাদী চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের কর্ম পরিধিকে পুনরায় সীমিত করে ন্যূনতম কর্মসূচি সম্পন্ন রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধাঁচের যে উদারনীতিবাদী তত্ত্বের অবতারণা করেন, তাকে নয়া উদারনীতিবাদ বলা হয়। বিংশ শতকের ৭ এর দশক থেকে এই তত্ত্ব ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা গন:- নয়া উদারনীতিবাদের প্রধান প্রবক্তারা হলেন -ফেডারিক হায়েক, মিলটন ফিডম্যান, জন রলস, রবার্ট নজিক প্রমুখ।
নয়া উদারনীতিবাদের বৈশিষ্ট্য:- নয়া উদারনীতিবাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
(i) ন্যূনতম কর্মসূচি সম্পন্ন রাষ্ট্র:- দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর শিল্পভিত্তিক সমাজে উদারনৈতিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলি জনকল্যাণকামী কর্মসূচি রূপায়ণ করতে গিয়ে অতি ক্ষমতাশালী ও আমলাতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ব্যক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ফলে উদারনীতিবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে নবপ্রজন্মের উদারনীতিবাদী চিন্তাবিদরা ন্যূনতম কর্মসূচি সম্পন্ন রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সুপ্রতিষ্ঠা করেন।
(ii) অবাধ বাণিজ্য নীতি:- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো রকম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়া উদারনীতিবাদ পছন্দ করেনা। নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে ব্যক্তিকে প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে তার অর্থনৈতিক জীবনকে সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হতে হবে। তাই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে রেখে সম্পূর্ণ ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন।
(iii) মুক্ত বাজার অর্থনীতি:- নয়া উদারনীতিবাদ মুক্তবাজার অর্থনীতিকে স্বীকৃতি দেয়। তারা মনে করে, একমাত্র অনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির প্রাচুর্য ও দক্ষতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। জন রলস তার থিওরি অফ জাস্টিস গ্রন্থে বাজার অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা কে ব্যক্তিস স্বাধীনতা ও অধিকার বাস্তবায়নের পূর্ব শর্ত বলে দাবি করেন।
(iv) রাষ্ট্রের কাজ সীমিতকরণ:-নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে যে - নিরাপত্তা রক্ষা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিরক্ষামূলক কাজ ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো কাজ থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির প্রাধান্য থাকবে, এতে রাষ্ট্র কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
(v) ন্যায় সঙ্গত সমাজ গঠন:-নয়া উদারনীতিবাদ ন্যায় সংগত সমাজ গঠনের কথা বলে যেখানে স্বাধীনতা, সুযোগ, আয়, সম্পদ ও ক্ষমতার ন্যায্য বন্টন থাকবে। সাংবিধানিক উপায়ে জনগণের রাজনৈতিক ও পৌর অধিকার গুলির সমান উপভোগের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তবেই ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে।
(vi) ব্যক্তির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রদান:- নয়া উদারনীতিবাদী চিন্তাধারার অন্যতম প্রবক্তা রবার্ট নজিক মনে করেন-ব্যক্তি বা ব্যক্তি জীবনের বাইরে কোনো সামাজিক অধিকার থাকবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বতন্ত্রের সংরক্ষণের নিরিখে রাষ্ট্রের সকল বিচার করা হবে। তার মতে ব্যক্তি নিজেই তার স্বাধীনতা ও অধিকারের সামিল।
(vii) নিপীড়ন মূলক সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের বিরোধী:-নয়া উদারনীতিবাদীরা মনে করেন গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা শেষ অব্দি মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ায় তা পিরনমূলক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু উদারনীতিবাদ সব রকম নিপীড়নের বিরোধিতা করে। তাদের মতে শাসকের প্রধান কর্তব্য হবে জলকল্যাণ সাধন।
(viii) আমলাতন্ত্রের বিরোধিতা:- নয়া উদারনীতিবাদ আমলাতন্ত্রের তীব্রবিরোধিতা করে। তাদের মতে জন কল্যাণকর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনার মধ্যে আমলাদের ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে। আমলাতন্ত্র মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই আমলা তন্ত্র কে নিপীড়ন মূলক সরকার বলে মনে করা হয়।
উপসংহার:- নয়া উদারনীতিবাদ কে অনেকে নয়া ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ বলে অভিহিত করে থাকেন। নয়া উদারনীতিবাদ যে অর্থনৈতিক উদারনীতিবাদের পরিবর্তন করতে চায় তাকে অনেকে বাজার মৌলবাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই তত্ত্বে বাজার কে সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার চালিকাশক্তি বলে গণ্য করা হয়। এখানে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও বিশাল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিগত মালিকানা ও বাজার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবুও এক বিংশ শতকের বিশ্বায়নের যুগে এই মতবাদ যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে উঠেছে।
Comments
Post a Comment