উত্তর উপনিবেশবাদ

উত্তর উপনিবেশবাদঃ

 ১৯৮০-র দশকে উত্থিত একটি বিশেষ তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ হল উত্তর উপনিবেশবাদ। আসলে এই দৃষ্টিকোণটি উপনিবেশবাদ প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে অনুধাবনের একটি কৌশল। উত্তর উপনিবেশবাদী দৃষ্টিকোণের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত মার্কসবাদকেই উপনিবেশবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্রিটিক বলে মনে করা হত—যা পশ্চিমী উপনিবেশবাদী বিজয় অভিযানকে ব্যাখ্যা করেছিল পশ্চিমী শক্তিগুলির অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক দমনপীড়নের ভিত্তিতে। এই ভাবনাচিন্তা থেকেসরে এসে উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকেরা উপনিবেশবাদী সাফল্যকে সাংস্কৃতিক আধিপত্য স্থাপনের একটি প্রয়াস হিসাবে ব্যাখ্যা করেন এবং যুক্তি দেন যে উপনিবেশবাদের টিকে থাকার কারণ তা এই যে, জনগণকে একটি বিশেষ অনুকুল সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। এই বিষয়টি বোঝাতে- এরা সক্ষম হন যে উপনিবেশকারী শক্তিটি উন্নততর এবং উপনিবেশকারীরা উপনিবেশায়িত মানুষের (অর্থাৎ যারা উপনিবেশবাদের শিকার সেইসব মানুষের হিতার্থেই তাদের শাসন করে। শুধু তাই নয়, প্রভুত্বকারী পশ্চিম প্রভৃত্বাধীন পূর্বের তুলনায় উন্নততর। উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকেরা মনে করেন যে, পূর্বোক্ত উপনিবেশবাদী সংস্কৃতি ও চেতনা প্রভূত্বাধীন জনগোষ্ঠীর উপর সফলভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হওয়ায় উপনিবেশায়িত জনগোষ্ঠীকে তা বহু বছর ধরে সাংস্কৃতিক দাসত্বে বেঁধে রেখেছে। ফলতঃ প্রভুত্বাধীন উপনিবেশায়িত মানবগোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতার বার্তা বহন করে আনতে পারেনি। প্রসঙ্গেক্রমে বলা চলে যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী অবস্থান যেভাবে উপনিবেশবাদকে বিশ্লেষণ করেছে তাকে বেশ তীব্রভাবেই সমালোচনা করেছে উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকেরা কিন্তু উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক অবস্থানটিও কিন্তু সমানভাবে সমালোচিত হয়েছে। এই এককটিতে এই সমস্ত বিষয়গুলিকেই আলোচনার মধ্যে দিয়ে উত্তর উপনিবেশবাদী চেতনার একটি রূপরেখা নির্ণয় করা হবে।

1978 সালে এডওয়ার্ড সাইদ-এর 'Orientalism' গ্রন্থটি উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিক আলোচনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে। এক্ষেত্রে সাইদ গ্রামশি-র ধারণাকে ব্যবহার করে তাঁর Orientalism এর মূল যুক্তি কাঠামোটিকে নির্মাণ করেন এবং দেখান যে, অর্থাৎ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যে সম্পর্ক তা মূলতঃ ক্ষমতার ও দমনের এক বিবিধ মাত্রায় আধিপত্য স্থাপনের। এই সম্পর্কটি আবার কতকগুলি ভিত্তিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে বলে সাইদ মনে করেন, যেমন—

(ক) 'প্রাচ্য' সম্পর্কে ইউরোপীয় জ্ঞান কখনই নির্মোহ বা নিরপেক্ষ নয় বরং এই জ্ঞান বিশেষভাবেই একটি উদ্দেশ্যসাধনের জন্য নির্মিত জ্ঞান। ব্যাখ্যা করে বলা যায় যে 'প্রাচ্য' বিষয়ক পশ্চিমী জ্ঞানচর্চা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যতাড়িত নয় বরং এর বিপরীতে 'প্রাচ্য'-কে বিশেষভাবে নির্মাণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। ফলতঃ 'প্রাচ্য'-কে নির্মাণ করার প্রকল্পটি ভীষণভাবেই রাজনৈতিক- যা সাংস্কৃতিকভাবে সংকীর্ণ পক্ষপাতিত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
(খ) সাইদ মনে করেন যে, পশ্চিমের প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিকেরা অধিকাংশই 'প্রাচ্যে'র বাইরের বাসিন্দা। ফলতঃ সেই অবস্থান থেকে প্রাচ্যের বাস্তবতাকে অনুধাবন করা যা সেই বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করার বৈধ ক্ষমতা তাদের নেই। এক্ষেত্রে তাদের বিবৃতি প্রাচ্যের প্রকৃত বাস্তব ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন।
সাইদ আরও মনে করেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে 'পশ্চিম' এবং 'পূর্বে'-র মধ্যে যে সম্পর্ক তাকে প্রভাবিত করেছে দুটি বিষয়—

(ক) প্রাচ্য সম্পর্কে ইউরোপের মধ্যে গড়ে ওঠা এবং ব্যবস্থিত জ্ঞানচর্চা। সেই জ্ঞানচর্চার ভিত্তি ছিল উপনিবেশবাদী সংঘর্ষ এবং অবশ্যই একটি বিদেশী সভ্যতার প্রতি আগ্রহ। যদিও এই জ্ঞানচর্চা নিরপেক্ষ ছিল না বরং পক্ষপাতী এই জ্ঞানচর্চায় ব্যবহাত হয়েছিল তৎকালীন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চায় সাইদের ভাষায় বিকশিত বিবিধ শাখার তথ্য ও জ্ঞান যেমন-নূকূলতত্ত্ব (ethnology), তুলনামূলক সংস্থানতত্ত্ব (comparative analogy), ভাষাতত্ত্ব (philology)। শুধু তাই নয় এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল ইতিহাস-ও। এছাড়াও ঔপন্যাসিক, কবি, অনুবাদক এবং প্রতিভাবান পর্যটকদের বিবরণ এই সবই এই বিশেষ ব্যবস্থিত তত্ত্বচর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল।

(খ) এক্ষেত্রে পাশ্চাত্ত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে সম্পর্ককে দেখা হয়েছে সবল ও দুর্বলের মধ্যে সম্পর্কের মত। কারণ পশ্চিম (ইউরোপ) এই সম্পর্কে চিরকালই পূর্বের প্রতি সেইসব দৃষ্টিপাত করেছে যেভাবে দৃষ্টিপাত করে সরলপক্ষ তার দুর্বল প্রতিপক্ষের দিকে। পাশ্চাত্ত্য এক্ষেত্রে প্রাচ্যের বিপরীতে নিজেকে আদর্শস্থানীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৌশলে। ফলতঃ মনে হয়েছে পশ্চিম পাশ্চাত্র/ইউরোপ-ই যাবতীয় বিজ্ঞান, যুক্তি, জ্ঞানচর্চা ও প্রগতির পীঠস্থান। এর বিপরীতে পূর্ব হল পশ্চাদপদতা ও ক্ষয়ের প্রতীক। আর এই যুক্তিতেই উপনিবেশবাদের নৈতিক দাবী “সভ্য করার সর্মসূচি” বৈধতা অর্জন করতে চেষ্টা করেছে, যেমন বৈধতা পেয়েছে 'প্রাচ্যবাদ'।
উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকরা যা দেখাতে চেষ্টা করেন, তা হল কিভাবে প্রাচ্যবাদীরা 'পূর্ব' (east)- কে 'পশ্চিমে'র (west) 'অপর' (other) হিসেবে নির্মাণ করে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে 'পূর্ব'-কে পশ্চিমের বিপরীতে দাঁড় করানোর জন্য 'পূর্ব'-কে এমনভাবে নির্মাণ করা হয় যা তাকে এক কল্পিত সুবর্ণজগত (golden world) বলে মনে হয়। তাছাড়া 'পূর্বে'-র জীবনযাত্রাকেও চিহ্নিত করা হয় আদিমতা মিশ্রিত সরলতা এবং নিষ্পাপ অজ্ঞতার দ্বারা। আর এই প্রেক্ষাপটেই দাবী করা হয় যে 'পূর্ব'-কে চিহ্নিত করা যায় কতকগুলি অনুন্নত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজ দ্বারা। সেখানে মানুষ মূলত প্রাকৃতিক রাজ্যের বাসিন্দা এবং মুক্ত ও অবাধ যৌনতায় বিশ্বাসী। আসলে পূর্ব-কে এভাবে চিত্রায়িত করে, তার একটি অবক্ষয়িত চেহারাকেই কল্পজগতে চর্চা করতে চায় পশ্চিম। এভাবেই প্রাচ্যবাদ পূর্বের স্বত অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চায় এবং পূর্বের অস্তিত্ব এক্ষেত্রে কেবলই পশ্চিমের সাপেক্ষে, পশ্চিমের অস্তিত্বের শর্তাধীনে গড়ে ওঠে। প্রাচ্যবাদীদের পক্ষে এজাতীয় নির্মাণ করা কঠিন হয় না কারণ তারা তাদেরআলোচনায় ব্যবহার করে কিছু ইউরোপীয় বর্গ' (European categories) এবং নিয়মনীতি যেগুলি দ্বারা সহজে প্রমাণ করা যায় যে পশ্চিম-ই আসলে বিজ্ঞান, যুক্তিবোধ এবং প্রগতির উৎসস্থল এবং এর বিপরীতে পূর্বকে চিহ্নিত করা যায় ধর্মীয় চেতনা কুসংস্কার, পশ্চাদপদতা এবং শৃঙ্খলাহীনতা দ্বারা।

উত্তর উপনিবেশবাদী তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে 'প্রাচ্য' সম্পর্কে প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিকদের এ জাতীয় বিশ্লেষণের মূলটি গ্রথিত আছে আলোকায়নজাত আধুনিকতাবাদের সঙ্গে, যা এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল যে 'পূর্ব' এবং 'পশ্চিম' সারসত্তাগতভাবে (essentially) শুধু পৃথক নয় বরং বিপরীত। আলোকায়নজাত আধুনিকতাবাদ বিশ্বজনীনভাবে এই সারসত্তাবাদ-কে বৈধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পিছুপা হয়নি।

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.