সামাজিক কল্যানবাদ

সামাজিক কল্যানবাদ

কেইনসের অর্থনীতির নির্দেশ অনুসরণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি এফ. ডি. রুজভেল্টের 'নয়া ব্যবস্থা' (New Deal) কর্মসূচী রূপায়িত হয়। এই কর্মসূচী বেকারত্ব দূরীকরণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে আশা সঞ্চার করে। এর প্রেক্ষিতে মুক্ত বাজার পদ্ধতির পরিবর্তে সক্রিয় রাষ্ট্র ও মিশ্র অর্থনীতির পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। অবশ্যই সেক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিক্রমও লক্ষ করা যায়। গ্রেট ব্রিটেন ও পশ্চিম ইউরোপে সাধারণ স্রোতের বিরুদ্ধে ব্যতিক্রম রূপে উপস্থিত হন ফ্রিডরিল ভন হায়েক (১৮৯১–১৯৯২)। ১৯৪৪ সালে হায়েক-এর গ্রন্থ The Road to Serfdom প্রকাশিত হয়। ঐ গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন যে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অবশ্যম্ভাবীরূপে স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে। তাঁর এই গ্রন্থ গ্রেট বিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়দেশেই জনকল্যাণের সমর্থক ও কেইনসীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে প্রবল ভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হায়েকের আক্রমণ মূর্ত হয়ে ওঠে উইলিয়াম হেনরি বেভারিজ (১৮৭৯-১৯৬৩) কর্তৃক প্রস্তুত Report on Social Insurance and Allied Service (১৯৪২) বিরোধিতার মাধ্যমে। বেভারিজ ব্রিটেনে আয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক বীমার 'cradle to grave' প্রকল্পের প্রস্তাব করেন। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্রিটেনে পরবর্তী সময়ে নানা আইন প্রবর্তিত হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী গ্রেট ব্রিটেনে শ্রমিকদলের সরকারের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে বেভারিজের বেকারি (unemployment) সম্পর্কিত দ্বিতীয় রিপোর্ট (১৯৪৪) প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪৪ সালে সরকার এক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, সরকারের অর্থনৈতিক নীতির প্রথম লক্ষ্য বেকারত্ব দূরীকরণ। ১৯৪৫ সালে শিক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালের দি ন্যাশনাল ইনসুরেন্স অ্যাক্ট এবং দি ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস আইনের মাধ্যমে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের মতাদর্শ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হয়। আবাসন প্রকল্পে সরকারী ভর্তুকির ক্ষেত্রেও এই পদক্ষেপ অনুসৃত হয়।

এই ভাবে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র এবং সামাজিক নিরাপত্তা' সমার্থক হয়ে ওঠে। বাজারভিত্তিক সমাজে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্কে এক নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়। আলোচনা প্রসংগে এটা স্মর্তব্য যে, হায়েকের মাতো ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদ ব্যতিরেকে সর্বসম্মত ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ১৯৪০-এর দশকের আর্থ-রাজনৈতিক প্রয়োজনের নিরিখে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কিন্তু জনসল্যাণকর রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই মত পার্থক্যের প্রকৃতি রাজনৈতিক। বেভারিজসহ প্রথম গোষ্ঠীটি 'reluctant collectivists' নামে পরিচিত হন। এই গোষ্ঠী কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার এবং সেই লক্ষ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন যার মাধ্যমে সফলভাবে বেকারির সমস্যাকে সমাধান করা যাবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যাবে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি 'reformist socialists' নামে পরিচিত। এই গোষ্ঠীর সমর্থকেরা সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় বিশ্বাসী এবং এরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনকল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলায় আগ্রহী। এই কারণে এই গোষ্ঠী পরিকল্পিত এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের এবং প্রয়োজনীয় আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য নতুন আইন প্রণয়ণের বিষয় উল্লেখ করে। তৃতীয় গোষ্ঠীটি হায়েকের মতাবলম্বী রূপে পরিচিত। এঁরা মনে করেন যে, জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্য প্রচুর পরিমাণে সরকারী অর্থের বিনিয়োগ ও প্রয়োজনীয় আইন ও নিয়মাবলীসহ সম্প্রসারিত আমলাতন্ত্রের প্রয়োজন।
১৯৭০ থেকে জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সংকট দেখা দিতে থাকে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, যুদ্ধোত্তর সর্বসম্মতির (consensus) বিভাজন অথবা এই দুই উপাদানের সম্মিলিত কারণে জনকল্যাণে রাষ্ট্রে সংকট সৃষ্টি হয়। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ এবং শিক্ষা, আবাসন, স্বাস্থ্য ও চাকুরী মতো ক্ষেত্রে উন্নত পরিষেবার দাবী মেটানো কষ্টকর হচ্ছিল। আর একটি কারণ হল পারিবারিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন, বয়স্ক জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেকার যুবকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সামাজিক প্রয়োজন বৃদ্ধি

পায়।

অন্যদিকে মেরুকৃত রাজনৈতিক সংস্কৃতির চৌহদ্দিতে জনকল্যাণ রাষ্ট্র সমালোচিত হতে থাকে। দক্ষিণপন্থী সমালোচকরা যুক্তি দেখান যে, জনগণের নিজস্ব সমস্যা সমাধানে তাদের উদ্যোগকে জনকল্যাণ রাষ্ট্র নষ্ট করে। বেকারভাতার উপর বেকার যুবককে নির্ভরশীল করে তাকে অলস ব্যক্তিতে পরিণত করা হয়। বামপন্থীরা যুক্তি দেন যে, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র প্রায়শঃই 'oppressive' ছিল। শ্ৰেণী, লিঙ্গ, জাতিগত অসাম্যের মূল কারণ সমাধানে জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্র ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হতে থাকে।

গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৭৪-৭৯ সালে শ্রমিক সরকারের নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। এই নীতি পরিবর্তন দক্ষিণপন্থী সমালোচনার প্রত্যুত্তর বলা যেতে পারে। ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বে রক্ষণশীল দলের নির্বাচনী জয়লাভে এই নীতির পরিবর্তন পরিকল্পিত ভাবেই ঘটে। সংক্ষেপে বলা যায়, বেভারেজ প্রতিবেদনের সুপারিশ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ পশ্চাদপসরণ ঘটে। পূর্ণ চাকুরী থেকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষণীয়। ব্যক্তিগত আয়কর হার হ্রাস ও পরোক্ষ করে প্রত্যাবর্তন এই ধরণের পরিবর্তনের উদাহরণ। ১৯৮০ র দশকের শেষার্ধে জনকল্যাণৱতী রাষ্ট্র বিলুপ্তির পরিবর্তে পুনর্গঠিত ( restructured) হয়। অ-সরকারী (private), সরকারী (public) এবং স্বেচ্ছাসেবী (voluntary) ক্ষেত্রের পাশাপাশি অবস্থানের মাধ্যমে এক নতুন 'কল্যাণমুখী বহুত্ববাদী’ ('welfare pluralist') উদ্ভব ঘটে। ১৯৯০-এর দশকে বিশ্বায়নের জোয়ার আসায় বিশ্ব অর্থনীতির (global economy) আন্তর্জাতিকীকরণ জাতীয় সরকারের স্বশাসনের ধারণাটি প্রায় ধ্বংস হয়। চলমান বিনিয়োগকে আকর্ষিত করার জন্য মজুরী ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় হ্রাসের উপর গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পশ্চিমী জগতে জনকল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের বিবর্তন বিশ্লেষণ প্রসংগে G. Esping Anderson বাজার ভিত্তিক সমাজে মূলতঃ যে তিন প্রকার রাষ্ট্রের উল্লেখ করেছেন তা হল 'conservative, social democratic" এবং "liberal' জনকল্যাণকর রাষ্ট্র। প্রথম প্রকারের উদাহরণ জার্মানী, দ্বিতীয় প্রকার হল সুইডেন এবং ব্রিটেন হল তৃতীয় প্রকার। গ্রেট ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষভাবে পরিবর্তন ঘোষিত হল। এমনকি, গ্রেট ব্রিটেনে ১৯৯৭ সালে শ্রমিক দল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৩ সালে গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতাসীন হলেও, সরকারের কার্যক্রমে উদারনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলির পরিবর্তন ঘটেনি।
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কমিউনিষ্ট-শাসিত দেশগুলি (তথাকথিত 'দ্বিতীয় বিশ্ব') থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। স্বাধীনতা (liberty) ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না কিন্তু তা সংকুচিত হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল মস্তবা করেছিলেন, “thing left to thernselves inevitably decay”. সামুহিকীবাদ (totalitarianism), ফ্যাসীবাদের দিক থেকেও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিখ্যাত দার্শনিক জন রলস্ উদারনৈতিক নীতি নতুনভাবে উপস্থাপিত করেন। জনকল্যাণকর রাষ্ট্র সম্পর্কে আকর্ষণ ও উৎসাহ ১৯৭০-এর দশক থেকে হ্রাস পেতে থাকে, কারণ সামাজিক ন্যায়ও সমতা এই নীতি গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। রলস্ ন্যায়নীতি সম্পর্কিত তাঁর মূল্যবান তত্ত্ব রচনা করলেন এবং দেখালেন যে, উদারনৈতিকতাবাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, বরং উদারনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা অপরিহার্য।

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.