১) জনপ্রশাসনের সংজ্ঞা দাও। এর প্রকৃতি বা পরিধি এবং মূল বিষয়বস্তু আলোচনা করো।
১) জনপ্রশাসনের সংজ্ঞা দাও। এর প্রকৃতি বা পরিধি এবং মূল বিষয়বস্তু আলোচনা করো।
সংজ্ঞাঃ
জনপ্রশাসন পদটির মধ্যে দুটি শব্দ আছে - জন ও প্রশাসন। 'জন' শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল পাবলিক বা জনগণ অন্যদিকে 'প্রশাসন' বলতে বোঝায় জনসাধারণের কাজকর্মের পরিচালন। সুতরাং আভিধানিক অর্থে জনপ্রশাসন হল সমগ্র জনগণের সমস্ত রকম কাজকর্মের সামগ্রিক পরিচালন। উড্রো উইলসনের মতে, জনপ্রশাসন হল জনসাধারণের নিমিত্ত রচিত আইনের অনুপুঙ্খ ও শৃঙ্খলাপরায়ণ বাস্তব রূপায়ণ। ফিফনার প্রেসথাসের মতে জনসাধারণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সাধারণ নীতিসমূহের বাস্তবায়নের যে প্রক্রিয়া তাকে জনপ্রশাসন বলে।
আমেরিকার ২৮তম রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন (WOODROW WILSON) হলেন লোকপ্রশাসনের জনক।উনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে লোকপ্রশাসনকে স্বতন্ত্র বিবেচ্য বিষয় হিসেবে পৃথক করেন।এ জন্য তাকে লোকপ্রশাসনের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
কয়েকটি সংজ্ঞা :
১। লোকপ্রশাসন বিজ্ঞানী পল এইচ এপলবি বলেন,“লোকপ্রশাসন হচ্ছে নীতি প্রণয়ন। তবে এ নীতি প্রণয়ন স্ব-ইচ্ছায় প্রণীত কিংবা একান্তভাবে নিরবিচ্ছিন্ন নীতি প্রণয়ন নয়।”
২। L.D.WHITE(public administration) এলডি হোয়াইটের মতে ‘‘সরকারি নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব কাজই হচ্ছে প্রশাসন।” public administration consists of all those operations having for their purpose the fulfilment or enforcement of public policy.
৩। PROF. WOODROW WILSON (the study of administration) উড্রো উইলসনের মতে “ প্রশাসন একটি সুবিন্যস্ত ও বিস্তারিত আইনের প্রয়োগ। প্রতিটি নির্দিষ্ট আইনকে কাজে পরিণত করাই হচ্ছে এক কথায় প্রশাসন।’; তার ভাষায় "public administration as detailed and systematic execution of public law."
৪। MARSHALDIMOCK ডিমকের মতে “প্রশাসন সরকার কী এবং কীরূপ তা নিয়ে আলোচনা করে।” administration is concerned with the 'what' and the 'how' of Government.
৫। সাইমন বলেছেন, “সাধারণ অর্থে প্রশাসন বলতে জাতীয়, কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় সরকারের কার্যনির্বাহী বিবাগের কাজকে বুঝায়।”
৬। FW WILLOUGHBY ( Principles of public administration -1927) বৃহত্তর অর্থে জনপ্রশাসন বলতে প্রকৃত সরকারি কার্য পরিচালনা কে বোঝায়, কোনো বিশেষ সরকারি বিভাগের কাজকে নয় ; সংকীর্ণ অর্থে শাসন বিভাগের কার্য পরিচালনাই জনপ্রশাসন হিসেবে চিহ্নিত হয়।
প্রকৃতি পরিধি বা বিষয়বস্তুঃ
জনপ্রশাসনের বিষয়বস্তু কী হবে বা এর পরিধি কতটুকু সে সম্পর্কে আগাম কিছু বলা যায় না। অতীতে এই বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য শাখা ছিল। বর্তমানে বহু দেশে জনপ্রশাসন নিয়ে নতুন-নতুন চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ফলে জনপ্রশাসনের পরিধি বা বিষয়বস্তু ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও জনপ্রশাসনের নিম্নলিখিত প্রকৃতি, পরিধি বা বিষয়বস্তুর কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি-
১) জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ঃ
জনপ্রশাসন শব্দদুটির মধ্যেই এর বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জনসাধারণের স্বার্থ, পরিসেবা ও প্রয়োজনের সঙ্গে জড়িত এমন সমস্ত বিষয় নিয়ে জনপ্রশাসন আলোচনা করে বলে এর বিষয়বস্তু অনেক বিস্তৃত। আবার অনেকে বিরুদ্ধ মতও পোষণ করেন। তাঁরা বলেন 'জন' কথাটি প্রশাসনের আগে থাকার জন্য উদারপন্থী রাজনীতিক কাঠামোতে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশাসন ব্যবস্থা সরকারি বা জনপ্রশাসনের আওতায় আসেনা এবং সেই কারণে এর পরিধি রীতিমতো সংকীর্ণ।
২) জনসাধারণের স্বার্থ-সম্পর্কিত নীতির বাস্তব রূপায়ণঃ
প্রখ্যাত জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এল.ডি. হোয়াইট এর মতে, জনসাধারণের স্বার্থ-সম্পর্কিত নীতিগুলির বাস্তব রূপায়ণই হল জনপ্রশাসন। যদিও হোয়াইট খুব স্পষ্ট করে বিষয়টির পরিধি বিশ্লেষণ করে যাননি। তবু আমরা মনে করি গতিশীল সমাজে মানুষের প্রয়োজন বা চাহিদা সবকিছুই দ্রুত বদলে যায় এবং কোনো সরকার সেটিকে উপেক্ষা করতে পারেনা। তাই রাজনীতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে জনপ্রশাসনকেও তাল রেখে চলতে হয়। সমাজের পরিবর্তন ও প্রশাসনের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে জনপ্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৩) সরকারের তিন বিভাগের আলোচনাঃ
লুথার গালিকের মতে, জনপ্রশাসন কেবল সরকারের শাসনবিভাগের কাজকর্ম নিয়ে ব্যাপৃত থাকবে। লুথার গালিকের সময় সকলে জনপ্রশাসন সম্পর্কে কার্যত এই মনোভাব পোষণ করতেন: প্রশাসন মানে শাসনবিভাগ। কিন্তু আজকালকার দিনে সরকারের অন্য দুটি বিভাগ যথা- আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রশাসনের নানা ইস্যুর সাথে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক বাধ্যবাধকতাই আইন ও বিচারবিভাগকে প্ররোচিত করছে প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করতে। যেমন সাম্প্রতিককালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পরিবেশদূষণ থেকে শুরু করে অপরাধ ও দুর্নীতি দমন ইত্যাদি নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে বাধ্য করছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশানুযায়ী চলতে। বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় প্রশাসন আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা বা লঙ্ঘন কোনোটাই করতে পারছেনা।
৪) রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনাঃ
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে যে সরকারি প্রশাসনে জনগণের হস্তক্ষেপ ক্রমণ বাড়ছে এবং রাজনীতিক অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপে জনগণ তেমন উৎসাহ দেখাত না অথবা অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। বর্তমানে গণতন্ত্রের সম্প্রসারিত আকার জনগণের হস্তক্ষেপকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং জনপ্রশাসনও রাজনৈতিক আলোচনার সাথে জড়িয়ে পড়ছে।
৫) প্রযুক্তিবিদ বা বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তিঃ
অতীতে কেবল সাধারণবিদ নিয়ে প্রশাসন চলত। আজ বিশেষজ্ঞরা দলে-দলে প্রশাসনে প্রবেশ করছেন। প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে চলতে হলে সাধারণ প্রশাসনকে নানা ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হতে হচ্ছে। ফলে জনপ্রশাসন প্রযুক্তিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নানা বিষয়ে পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। অতএব জনপ্রশাসনের কাজের পরিধি বা এর বিষয়বস্তু যে বৃদ্ধি পেয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
৬) PODSCORB;
লুথার গালিক ও আরউইক জনপ্রশাসনের একটি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। তাঁরা PODSCORB নামে একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করে গেছেন। PODSCORB কথাটি সাতটি শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে গঠিত। এই শব্দগুলি হল Planning (পরিকল্পনা), Organisation (সংগঠন), Direction (নির্দেশনা), Staffing (কর্মী নিয়োগ), Coordination (সমন্বয় সাধন), Reporting (প্রতিবেদন পেশ), এবং Budgeting (আয়-ব্যয় নির্ধারণ)।যে-কোনো দেশের প্রশাসনিক সাফল্য এই কাজগুলির সম্পাদনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
৭) ভারতীয় প্রেক্ষিতঃ
ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনপ্রশাসনে সরকারের তিনটি বিভাগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য জনপ্রশাসন নিবিড়ভাবে জড়িত। এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমবায় প্রভৃতির সঙ্গে এর সম্পর্ক আমরা প্রত্যক্ষ করি। অর্থাৎ সমাজজীবন ও রাজনীতিক জীবনের কোনো ক্ষেত্রই জনপ্রশাসনের এক্তিয়ার থেকে মুক্ত নয়। ভারতের জনপ্রশাসন যেমন সংগঠনের দিকটি দেখে ঠিক তেমনি নির্দেশ দান ও নীতিসমূহের বাস্তবায়নের দিকটিও সমান গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে।
Comments
Post a Comment