একটি স্বাধীন শাস্ত্র রূপে জনপ্রশাসনের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলি বিশ্লেষণ করো।

একটি স্বাধীন শাস্ত্র রূপে জনপ্রশাসনের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলি বিশ্লেষণ করো।


জনপ্রশাসনের বিকাশ বা বিবর্তনঃ

আধুনিক জনপ্রশাসনের ক্রমবিকাশ একদিনে হয়নি, এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস। ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত উড্রো উইলসনের "The Study of Administration" প্রবন্ধটির মাধ্যমে জনপ্রশাসন বিষয়টির সূত্রপাত ঘটে বলে মনে করা হয়। নীচে জনপ্রশাসনের বিকাশ বা বিবর্তনের এই বিভিন্ন পর্যায়গুলি আলোচনা করা হল-

প্রথম পর্যায়; জন প্রশাসন ও রাজনীতির পৃথকীকরণঃ (১৮৮৭-১৯২৬)

জনপ্রশাসনের বিবর্তনের প্রথম পর্যায়টি ১৮৮৭ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যান্ত বিস্তৃত ছিল। জনপ্রশাসনের বিবর্তনের এই পর্যায়ে জন প্রশাসন ও রাজনীতির পৃথকীকরণের উপর জোড় দেওয়া হয়। ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত উড্রো উইলসনের "The Study of Administration" প্রবন্ধটির মাধ্যমে এই পৃথকীকরণের সূত্রপাত ঘটে। এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে রাজনৈতিক কাজ এবং প্রশাসনিক কাজ- এই দুইয়ের মধ্যে বিভাজনরেখা টানা হয়। এটিকে রাজনীতি- প্রশাসন বিভেদ বলে। এছাড়া ১৯০০ সালে প্রকাশিত এফ জে. গুডনাউ এবং এল ডি. হোয়াইট এর Politics and Administration গ্রন্থে সরকারের দুটি স্বতন্ত্র কাজের উল্লেখ করা হয়। প্রথমটি রাষ্ট্রের নীতি সম্পর্কিত যেটি রাজনৈতিক কাজ এবং দ্বিতীয়টি সেই নীতির রূপায়ণ সম্পর্কিত যেটি প্রশাসনিক কাজ নামে খ্যাত।

দ্বিতীয় পর্যায়; নীতি নির্ভর প্রশাসনঃ (১৯২৭-১৯৩৭)

জনপ্রশাসনের বিবর্তনের দ্বিতীয় পর্যায়টি ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যান্ত বিস্তৃত ছিল। জনপ্রশাসনের বিবর্তনের এই পর্যায়ে কতগুলি সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নীতি অনুসরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মনে করা হয় যে জনপ্রশাসনের আলোচনায় বিজ্ঞানসম্মত নীতি অনুসরণ করলে প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত উইলোবির Principal of Public Administration গ্রন্থে নীতিনির্ভরতা এত গুরুত্ব পায় যে রাজনীতি-প্রশাসনের মধ্যে বিভাজন প্রাতিষ্ঠানিক বৈরিতার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয় এবং মূল্যবোধের অবশ্যম্ভাবিকতাকে অস্বীকার করা হয়। এছাড়া ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত লুথার গুলিক ও আরউইকের Papers on the Science of Administration গ্রন্থে জনপ্রশাসনের ৮টি মৌলিক নীতির উল্লেখ করা হয় যা POSDCORB নামে পরিচিত।

তৃতীয় পর্যায়; তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদের যুগঃ (১৯৩৮-১৯৪৭) 

জনপ্রশাসনের বিবর্তনের তৃতীয় পর্যায়টি ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৭সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জনপ্রশাসনের বিবর্তনের এই পর্যায়ে জনপ্রশাসনের ধারনা নিয়ে বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক বা বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়। যেভাবে নীতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জনপ্রশাসন এতদিন ধরে গড়ে উঠেছিল তা ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত চেষ্টার আই বার্নার্ড এর "The Functions of the Executive' বইটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে কিছুটা বৌদ্ধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। মূলত, দুটি দিক থেকে জনপ্রশাসনের তাত্ত্বিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়-

প্রথমত, যেভাবে রাজনীতি ও জনপ্রশাসনের মধ্যে বিভাজনরেখা টানা হচ্ছিল, তা বাস্তবে কখনোই সম্ভব নয় বলে নতুন প্রজন্মের তাত্ত্বিকেরা মনে করছিলেন।

দ্বিতীয়ত, ১৯৪০ সাল থেকে যেসব তাত্ত্বিক রচনা প্রকাশিত হচ্ছিল তাতে প্রশাসনিক নীতিসমূহ সমালোচিত হয়। প্রশাসনের মধ্যে বিশ্বজনীন, চূড়ান্ত নীতি পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এছাড়া ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত এফ এম ম্যাক্স এর Elements of Public Administration প্রবন্ধে রাজনীতি ও জনপ্রশাসনের যে বিভেদরেখা এতদিন প্রচলিত ছিল তার অসারতা তুলে ধরা হয়।

চতুর্থ পর্যায়; জনপ্রশাসনের পরিচিতির সংকটঃ (১৯৪৮-১৯৭০)

জনপ্রশাসনের বিবর্তনের চতুর্থ পর্যায়টি ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যান্ত বিস্তৃত ছিল। জনপ্রশাসনের বিবর্তনের এই পর্যায়ে জনপ্রশাসন এক বিরাট সংকটকালের সম্মুখীন হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন হয় যে, এই সময়ে জনপ্রশাসন শাস্ত্রের নিজের স্বাধীন সত্তা বা স্বকীয়তার পরিচয় বজায় রাখাই এক রকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ফলে এই পর্যায়ে জনপ্রশাসন তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এই সময় ১৯৫২ সালে American Political Science Review-এ রসকো মার্টিন এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যেখানে জনপ্রশাসনের আলোচনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুপ্রবেশ আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়। ১৯৬০ সালে Comparative Administraton Group বা CAG প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনপ্রশাসন বিষয়ে গবেষণার জন্য এই সংস্থ্যাকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রিগস CAG-র সভাপতি ছিলেন এবং তাঁর বৌদ্ধিক নেতৃত্ব এবং গবেষণার মধ্যে দিয়ে তুলনামূলক জনপ্রশাসন অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়।

পঞ্চম পর্যায়; নয়া জন প্রশাসনঃ (১৯৭১-বর্তমান)

জনপ্রশাসনের বিবর্তনের পঞ্চম পর্যায়টি ১৯৭১ থেকে বর্তমান সময় পর্যান্ত বিস্তৃত। জনপ্রশাসনের বিবর্তনের এই পর্যায়ে নতুন জনপ্রশাসনের ধারনা তুলে ধরা হয়, যেখানে জনপ্রশাসনের সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেমন যোগসুত্র স্থাপনের কথা বলা হয় তেমনি জনপ্রশাসনকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্ঠা করা হয়। ১৯৭১ সালে ডোয়াইট ওয়াল্ডো এর সম্পাদনায় Toward A New Public Administration: The Minnowbrook Perspective গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। যেখানে দক্ষতা, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, ব্যয়সংকোচ ইত্যাদি পুরানো বিষয় নিয়ে যেমন আলোচনা হয় তেমনি, প্রশাসনে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তির সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক ইত্যাদি নতুন বিষয়ও আলোচনা করা হয়।

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.