বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ /অনুশীলন তত্ত্ব
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ /অনুশীলন তত্ত্ব
ঊনবিংশ শতক বাঙ্গালী জীবনে এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমরা বাঙ্গালী মহাপুরুষ বলতে মূলত যাঁদের বুঝি তাঁদের প্রায় সকলেরই জন্ম এই শতকে। কিন্তু এই শতকেই কিছু ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালী পাশ্চাত্ত্যের অন্ধ অনুকরণে ব্রতী হয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে যারা পাশ্চাত্ত্যের দর্শন-ইতিহাস থেকে শেখার পাশাপাশি ভারতীয় সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ধর্ম থেকেই ভারতীয়দের আত্মশক্তি অর্জন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত বলে মনে করতেন তাঁদের পুরোধা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁর The Extremist Challenge গ্রন্থে (যার বাংলা অনুবাদ হল ভারতের মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব) ভারতীয় রাজনীতিতে চরমপন্থী মতবাদের ভাবগত পটভূমি তৈরীর পিছনে তিনজন ব্যক্তিত্বের ভূমিকার কথা বলেছেন – বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ ও দয়ানন্দ সরস্বতী। Charles Himesath তাঁর The Indian Nationalism and Hindu Social Reform গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-কৃতির মধ্যেই চরমপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের উৎস আবিষ্কার করেছেন। বহু ইউরোপীয় ও ভারতীয় পণ্ডিতও একই মনোভাব পোষণ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে, বিদেশ থেকে আমদানী করা কোন তত্ত্ব নয়, এ দেশের আবহাওয়া, মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহ্যই তার ভিত্তি হতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্রের বিভিন্ন লেখালেখি কিভাবে জাতীয়তাবাদ ও চরমপন্থার আদর্শগত উৎস হিসাবে কাজ করেছিল- এবার সেগুলোই একটু দেখা যাক।
কৃষ্ণচরিত্রঃ বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশিত হবার পর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শ্রীকৃষ্ণই হয়ে ওঠেন চরমপন্থী মাত্রেরই আদর্শ পুরুষ। বঙ্কিমের কৃষ্ণ হলেন গীতার শ্রীকৃষ্ণ। যিনি বলেন
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুথানধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।।’’
এই শ্রীকৃষ্ণ অতি দূরে সরে থাকা, নির্লিপ্ত ঈশ্বর নন। তিনি ধর্ম সংস্থাপনের জন্য দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কাজে সদা তৎপর। শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলীর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁর অতুলনীয় নেতৃ-প্রতিভার ওপর, তাঁর সামরিক জ্ঞান ও সাম্রাজ্য সংগঠনী কুশলতার ওপর। শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্ন দেখেছিলেন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষের, আর এই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্যই কুরুক্ষেত্রে অগণিত ক্ষুদ্র সামন্ত রাজাকে বিনাশ করে এক সুবিশাল, সংহত ধর্মরাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের এই ধর্মরাজ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের পররাজ্যলিপ্সু উগ্র জাতীয়তাবাদের কোন সাদৃশ্য ছিল না।
বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশিত হবার পর তিলক রচনা করলেন গীতার মারাঠি ভাষ্য, অরবিন্দ লিখলেন গীতার দীর্ঘ ভূমিকা, লাজপৎ রায় উর্দু ভাষায় শ্রীকৃষ্ণের জীবনী প্রণয়ন করলেন, ভক্তিযোগের ব্যাখ্যা লিখলেন অশ্বিনী কুমার দত্ত, ব্রাহ্ম বিপিনচন্দ্র পাল শ্রীকৃষ্ণকে ‘ভারত-আত্মা’ হিসাবে অভিহিত করেন, এমনকি ক্যাথলিক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় লিখে ফেললেন – শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব। এতটাই ছিল বঙ্কিমের কৃষ্ণ চরিত্রের প্রভাব।
ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন): বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন) গ্রন্থের আদর্শে ও এর নাম অনুসারে বঙ্গের সবথেকে খ্যাতনামা বিপ্লবী সমিতি ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০২-এ। অনুশীলন সমিতির বিশিষ্ট বিপ্লবী জীবনতারা হালদার তাঁর অনুশীলন সমিতির ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন যে ‘‘ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সমন্বিত আদর্শ মানব গঠনের যে নির্দেশ আছে তাহাই হইল অনুশীলন সমিতির ভিত্তি।’’
আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরম্ঃ আনন্দমঠ ও বন্দে মাতরম্ হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান। আনন্দমঠ উপন্যাসে ভবানন্দ সর্বপ্রথম মহেন্দ্রকে ‘বন্দে মাতরম্’ গেয়ে শোনান। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় আনন্দমঠ লেখা হয়েছিল। দেশকে দেশমাতৃকা রূপে দেখান এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের সবথেকে বড় কৃতিত্ব।
এই উপন্যাসে আমরা দেখি ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে বিভিন্ন যুগে দেশমাতৃকার নানা রূপ দেখাচ্ছেন। প্রথমে ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে দেখাচ্ছেন, এক অপরূপ সর্বাঙ্গসম্পন্না, সর্বাঙ্গবরণভূষিতা জগদ্ধাত্রী মূর্তি। মহেন্দ্র তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে ব্রহ্মচারী সর্বানন্দ বললেন, ‘‘মা যা ছিলেন’’। তারপর ব্রহ্মচারী কক্ষান্তরে মহেন্দ্রকে নিয়ে গিয়ে দেখালেন মা কালীর মূর্তি। বললেন ‘‘দেখ, মা যা হইয়াছেন।…… কালী- অন্ধকারসমাচ্ছন্না, কালিমাময়ী। হৃতসর্বস্বা, এই জন্য নগ্নিকা। আজি দেশের সর্বত্রই শ্মশান তাই মা কঙ্কালমালিনী।’’ তারপর ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে দেখালেন মর্ম্মর প্রস্তর নির্মিত একটি মন্দিরের মধ্যে সোনার তৈরী দশভুজা দুর্গা প্রতিমা। ব্রহ্মচারী মহেন্দ্রকে বললেন, ‘‘এই মা যা হইবেন। দশভুজ দশ দিকে প্রসারিত, তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত, পদতলে শত্রু বিমর্দিত, পদাশ্রিত বীরকেশরী শত্রু নিপীড়নে নিযুক্ত, দিগভুজা, নানা প্রহরণধারিণী, শত্রুবিমর্দিনী বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী, দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরুপিণী, বামে বাণী বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী, সঙ্গে বলরুপী কার্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরুপী গণেশ।’’ মহেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে জিজ্ঞাসা করল যে, মায়ের এই মূর্তি কবে দেখতে পাব? উত্তরে ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ বললেন, ‘‘যবে মার সকল সন্তান মাকে মা বলিয়া ডাকিবে, সেইদিন উনি প্রসন্ন হইবেন।’’
এখানে বিভিন্ন দেবীমূর্তির কথা বলে বঙ্কিমচন্দ্র বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষের অবস্থা বোঝাতে চেয়েছেন। প্রথমে স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা জগদ্ধাত্রী হচ্ছেন প্রাচীন সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষের প্রতীক। তারপর নগ্নিকা, হৃতসর্বস্বা, শ্মশানচারিণী মা কালী মুসলিম ও ব্রিটিশ আমলে অত্যচারিতা, লুণ্ঠিতা, পরাধীনা দেশমাতৃকার প্রতীক। এরপর লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক সহ স্বর্ণনির্মিত দশভুজা দুর্গা মূর্তির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতবর্ষের এক প্রতিচ্ছবি অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন বঙ্কিম।
ঋষি অরবিন্দের ভাষায় বন্দেমাতরম্ ধ্বনি এক নতুন ধর্মের জন্ম দিল, যা হল দেশপ্রেমের ধর্ম। বঙ্কিমচন্দ্র ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, একদিন দেখিবে এই গানে বঙ্গদেশ মাতিয়া উঠিবে। বাস্তবে হয়েছিলও তাই। ১৯০৫ থেকেই বঙ্গসমেত সারা ভারতবর্ষে বন্দেমাতরম্ দেশপ্রেমের মন্ত্র। স্বাদেশিকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। অনুশীলন সমিতির আদর্শের অন্যতম উৎসও হয়ে দাঁড়ায় আনন্দমঠ ও বন্দেমাতরম্।
বঙ্কিমের ইতিহাস চেতনাঃ বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘সাহেবরা যদি পাখি মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই।’’ বঙ্কিম বুঝেছিলেন সঠিক ইতিহাস-জ্ঞান একটি জাতির উত্থানের জন্য আবিশ্যিক। আর মিথ্যা, বিকৃত ইতিহাস যে একটি জাতিকে ভিতর থেকে ফাঁপা করে দিতে পারে তাও তিনি বুঝেছিলেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘‘ঐতিহাসিক গবেষণায় বঙ্কিমচন্দ্র’’ প্রবন্ধে ইউরোপে যখন বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস-চর্চার শৈশবাবস্থা এবং বঙ্গে যখন ইতিহাসচর্চা প্রায় শুরুই হয়নি বলা যায়, সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস-চেতনা ও ইতিহাস-লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বঙ্কিম মিনহাজ উস সিরাজের তবকৎ-ই-নাসিরী-তে প্রাপ্ত বখতিয়ার খলজীর সপ্তদশ অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গ-বিজয়ের কাহিনিতে কোনদিনই বিশ্বাস করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘সপ্তদশ অশ্বারোহী লইয়া বখতিয়ার খিলিজি বাঙ্গালা জয় করিয়াছিল, একথা যে বাঙ্গালীতে বিশ্বাস করে, সে কুলাঙ্গার।’’ তিনি এই ঘটনাকে অসম্ভব বলে মনে করেন এবং বখতিয়ার যে বঙ্গের খুব কম অংশকেই দখল করতে পেরেছিলেন, তাও উল্লেখ করেন। বর্তমানে আমরা জানি যে বঙ্কিমের দাবী ঐতিহাসিকভাবে সত্য। বখতিয়ার শুধু কয়েক বছরের জন্য বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবঙ্গের কিছু অংশ দখলে রাখতে পেরেছিলেন। বাকি উভয় বঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলই লক্ষ্মণ সেনের পুত্র বিশ্বরূপ সেন, কেশব সেন-সহ তাঁর উত্তরাধিকারীরা বহু বছর যাবৎ শাসন করেন। মৃণালিনী উপন্যাসেও বঙ্কিম বখতিয়ার-সংক্রান্ত কিংবদন্তিটির বিরোধিতা করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র কি মুসলমান-বিরোধী ছিলেন? কিছু গবেষক বঙ্কিমকে মুসলমানবিরোধী, সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বঙ্কিম নিজেই ‘বঙ্গদর্শন’-এ ১২৮০ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় লিখেছেন যে, ‘‘বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানদের দেশ, একা হিন্দুর দেশ নহে।’’ ১৯৩৮-এ বঙ্কিম জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রেজাউল করীমের প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি সংকলন আকারে ১৯৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মুসলিম লীগের প্ররোচনায় কলকাতার রাস্তায় শত শত কপি আনন্দমঠ পোড়ানোর প্রতিবাদ করে রেজাউল করীম লেখেন, ‘‘আনন্দমঠকে অগ্নিদগ্ধ করিয়া ইহারা যে মনোবৃত্তির পরিচয় দিলেন তাহা অতীব জঘন্য। স্বাধীন চিন্তার পথ রুদ্ধ করিবার করিবার জন্য এই যে প্রচেষ্টা, ইহা ইসলামকে উদ্ধার করিবে না। ইহা লইয়া যাইবে মুসলমানকে অধঃপতনের দিকে…… ভূলুণ্ঠিত হইল মুসলমানের স্বাধীন চিন্তার শক্তি….।’’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘আজ আনন্দমঠের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছে, তাহা মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ দূর করিবার উদ্দেশ্যে নহে। তাহার মূল কারণ মুসলমান যাহাতে মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে তাহার জন্য কতকগুলি ছল বাহির করিবার দুরভিসন্ধি।’’ বন্দেমাতরম প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘‘অন্যান্য দেশের মুসলমানরা এরূপ গান ব্যবহার করিবার মত পরিস্থিতি পাইলে ধন্য হইয়া যাইতেন। তাই তাঁর মতে বঙ্কিমের নিকট যদি বাঙ্গালী ঋণী হয়, বাংলা ভাষা ঋণী হয়, তবে বাঙ্গালী মুসলমানও সমভাবে তাঁহার নিকট ঋণী, সর্বাংশে ঋণী।’’
রেজাউল করীম দেখাচ্ছেন যে, বঙ্গজননীর সপ্তকোটি সন্তানকেই বঙ্কিম স্বাধীনতার সংগ্রামে আহ্বান করছেন। তিনি বলেছেন, বন্দেমাতরম কোন হিন্দু দেবদেবীর পূজার গান নয়। এখানে দেশকে বন্দনা করা হয়েছে। তাকে কোথাও এবাদৎ বা সেজদা করতে বলা হয়নি। এই বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার। সেখানে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও বন্দেমাতরম্কে ইসলামবিরোধী সাজানোর মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরোধিতা করেছেন।
ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, ‘‘বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী কখনোই সৎ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেনি। তাঁর রচনায় নিন্দিত হয়েছিলেন কেবলমাত্র অত্যাচারী বা অপদার্থ মুসলমান শাসকবর্গ। তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনা চলত যদি তিনি আকবর বা হুসেন শাহের মত কোন সুশাসকের কুৎসা করতেন।’’ পশুপতি, ভবানন্দ, গঙ্গারাম, সীতারাম প্রভৃতি হিন্দু চরিত্রের খারাপ দিকও তিনি তুলে ধরেছেন।
বঙ্গদেশের কৃষকঃ বঙ্কিমচন্দ্র নিজ দেশীয় ঐতিহ্য, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতির ওপর জোর দিলেও কিছু বামপন্থী বা অতিবামপন্থী যেভাবে তাঁকে ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী বা এলিটিস্ট হিসাবে দাগানোর অপচেষ্টা করেন তা কখনই ঠিক নয়। কারণ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ও বর্ণের কথা আমরা তাঁর লেখায় পাই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। এই প্রবন্ধে তিনি বঙ্গের কৃষকদের দুরবস্থার কথা লিখেছেন। তৎকালীন সমাজের অধিকাংশ বিশিষ্ট ব্যক্তিই যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ- তখন তিনি এই ব্যবস্থার ফলে কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে কলম ধরেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গদেশের কৃষকদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান এবং বাকীরা তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু। কিন্তু এদের জন্যই বঙ্কিম কলম ধরেছিলেন।
চরমপন্থার উদ্ভবে বঙ্কিমচন্দ্রঃ কংগ্রেসের নরমপন্থীদের নীতি ও কর্মপন্থার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে বঙ্কিমচন্দ্রই চরমপন্থার উত্থানের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। কমলাকান্তের দপ্তরে ‘পলিটিকস্’ রচনায় তিনি কমলাকান্তের মুখ দিয়ে নরমপন্থীদের সমালোচনা করে বলিয়েছিলেন, ‘‘জয় রাধে কৃষ্ণ! ভিক্ষা দাও গো! ইহাই আমাদের পলিটিকস্।’’ তিনি এই প্রবন্ধে কলুর পুত্র সংক্রান্ত একটি গল্পে নরমপন্থীদের রাজনীতিকে ‘কুক্কুর জাতীয় রাজনীতির’ সঙ্গে তুলনা করেন এবং এর পরিবর্তে ‘বৃষ জাতীয় রাজনীতি’ গ্রহণ করার কথা বলেন।
এহেন বঙ্কিমচন্দ্র, যিনি শুধু সাহিত্যসম্রাট এবং বাংলা সাহিত্যের ভগীরথই নন, তাঁর রচনার সামাজিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। বঙ্গ তথা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উত্থানের পিছনে তাঁর রচনাগুলি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু তিনি কি তাঁর যথার্থ স্বীকৃতি পেয়েছেন? তাঁর এই অবদানগুলোকে নিয়ে কি যথেষ্ট চর্চা হয়েছে? ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উদগাতা ঋষি বঙ্কিমকে শুধুমাত্র নৈহাটির বঙ্কিম করে রাখার প্রয়াস কি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত? পাঠকদের ওপরই তা বিচারের ভার থাকল।
Comments
Post a Comment