হান্টার কমিশন সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন। হান্টার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করুন।

হান্টার কমিশন সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিন। হান্টার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করুন। 

পটভূমি:-

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচে প্রাথমিক ও দেশজ শিক্ষার উন্নতির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ডেসপ্যাচের ভাবধারা কে অবহেলা করে প্রাথমিক ও দেশজ শিক্ষার উপর গুরুত্ব না- দিয়ে শুধু উচ্চশিক্ষা ও সরকারি স্কুল কলেজগুলিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি একেবারেই হয় না। তাই সরকার প্রথমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করেন।

হান্টার কমিশন গঠন:-

এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপন ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা ফেব্রুয়ারি ২০ জন সদস্য নিয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এটি প্রথম "ভারতীয় শিক্ষা কমিশন” নামে পরিচিত। এই কমিশন স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল বলে একে "হান্টার কমিশন” বলা হয়।
স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার ছিলেন এই কমিশনের সভাপতি। অন্যান্য সদস্যরা হলেন- আনন্দমোহন বসু, কে.টি. তেলাং, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, প্রমুখ। প্রাথমিক শিক্ষা ও নিরক্ষরতা বিষয়ে এই কমিশনকে বিশেষভাবে বিচার করার কথা বলা হয়।

হান্টার কমিশনের রিপোর্ট পেশ:-

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কমিশন ২২২ টি প্রস্তাব সম্মিলিত ৬০০ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে ভারতের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থায় কোম্পানি ও ইংরেজ শাসনে শিক্ষার অগ্রগতি, শিক্ষার বিভিন্ন দিক, প্রাথমিক শিক্ষার অনগ্রসরতা, মাতৃভাষার অবহেলা প্রভৃতি সম্বন্ধে বিবরণ পেশ করে।

হান্টার কমিশনের উদ্দেশ্য:-
১) ভারতে উচ্চ শিক্ষার অগ্রগতি সম্বন্ধে পর্যবেক্ষণ করা।

২) উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ গুলি কার্যকর করার পর শিক্ষাব্যবস্থার তদন্ত করা।

৩) শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ভারতীয় ও মিশনারি প্রয়াসের গুরুত্ব নির্ণয় করা।

৪) প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা, মুসলিম শিক্ষার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা।

হান্টার কমিশনের সুপারিশ:-

হান্টার কমিশন যে সকল সুপারিশ করেছিলেন তা নিম্নে আলোচনা করা হল-

১)বিদ্যালয় ও শিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন:- 
দেশজ বিদ্যালয় গুলি অনুমোদন, সম্প্রসারণ শিক্ষকদের শিক্ষণ ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রবর্তন ইত্যাদি কার্যাবলীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে।

২) প্রাথমিক শিক্ষা:- 
কমিশনের মতে প্রাথমিক শিক্ষা হলো জনশিক্ষা প্রসারে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এ প্রসঙ্গে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গুলি হল-

i) দেশের জনগণের জন্য নূন্যতম শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
ii) শিক্ষার্থীরা দেশজ গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, কৃষিকাজ, স্বাস্থ্য ও শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে।
iii) প্রাথমিক শিক্ষা হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে।
iv) প্রাথমিক শিক্ষার সাংগঠনিক বৃত্তিকে জোরালো করতে হবে। 
v) বৈষম্যহীন শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
vi) দেশীয় বিদ্যালয় গুলিকে স্বীকৃতি দান করতে হবে।
vii) শিক্ষক- শিক্ষণ, পরীক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষা বোর্ড গঠন, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদির উপর সুপারিশ করা হয়েছে।
viii) অনুন্নত অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে।
ix) বিদ্যালয় পরিদর্শক নিয়োগ করতে হবে। ইত্যাদির ওপর সুপারিশ করা হয়েছে।

৩) মাধ্যমিক শিক্ষা:-
মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে সুপারিশ গুলি হল-
i) সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা।
ii) বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে সমান সুযোগ দান করা।
iii) মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান। iv)প্রতিটি জেলায় মডেল হিসেবে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন করা।
v) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে "A” কোর্স ও "B” কোর্স চালু করা।
"A” কোর্স হল সাধারণধর্মী শিক্ষা এবং "B” কোর্স হল বৃত্তিমুখী শিক্ষা।

৪) উচ্চশিক্ষা:-
i) উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি প্রচেষ্টা বন্ধ করা। 
ii) বেসরকারি উদ্যোগে মহা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আর্থিক সাহায্য দান। সঙ্গে সঙ্গে অনুদান দেওয়ার জন্য শর্তারোপের কথা বলা হয়েছে। 
iii) সরকারি পরিচালনায় আদর্শ কলেজ স্থাপন করা। 
iv) সকল দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করা এর সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাত্রার ব্যবস্থা করা।

৫) নারী শিক্ষা:-
I) নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনএবং এর সঙ্গে সঙ্গে নারী শিক্ষার পাঠক্রম, বৃত্তিদান,
ii) নারী পরিদর্শক নিয়োগ, 
iii) নারী শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক ভাবে নর্মাল ট্রেনিং স্কুল স্থাপন। প্রভৃতির ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়।

৬) মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা:-
মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক দেশজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা।

৭) নৈতিক শিক্ষা:-
i) শিক্ষার সকল স্তরে নৈতিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়। 
ii) বিদ্যার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনায় উৎসাহ দানের কথা বলা হয়।

৮) শিক্ষক- শিক্ষণ:-
i) শিক্ষক শিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা।
ii) শিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকরা যাতে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে শিক্ষকতা করতে পারেন তার সুপারিশ করা হয়।

৯) নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন:-
বয়স্ক ব্যক্তিদের শিক্ষাদানের জন্য কিছু কিছু নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

১০) পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন:- 
দেশীয় রাজন্যবর্গের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

১১) ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ:-
কমিশন সকল মানুষের শিক্ষার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণের সুপারিশ করেছেন।

হান্টার কমিশনের গুরুত্ব:- 

i) শিক্ষার ওপর থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস সম্পর্কিত সুপারিশ শিক্ষাক্ষেত্রে শুভ সূচনার ইঙ্গিত বহন করে।
ii) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কে প্রাথমিক শিক্ষার ভার অর্পণ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন।
iii) সহকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত সাহায্য করেছিল।
iv) মিশনারি ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশ সমর্থনযোগ্য।

সমালোচনা:- 
হান্টার কমিশন ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন। এই কমিশনে যেমন তার সুপারিশের ওপর গুরুত্বের দাবি রাখে, তেমনি তার কিছু সীমাবদ্ধতাও পরিলক্ষিত হয়।

হান্টার কমিশনের সীমাবদ্ধতা:-

১) কমিশন তার সুপারিশের মধ্য দিয়ে শিক্ষানীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেও কিভাবে সুপারিশসমূহ কার্যকরী হবে সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলেননি।
২) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অর্থসংস্থান সম্পর্কে অস্পষ্টতা ছিল, যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ব্যাহত হয়।
৩) কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দিলেও একে অবৈতনিক, সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা যায় নি।
৪) মুসলিমদের জন্য বিশেষ শিক্ষা পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িকভাবে উৎসাহ দিয়েছিল।
৫) কমিশন যে ফলের ভিত্তিতে অনুদান প্রথা চালু করেছিল তা শিক্ষা বিভাজন সঙ্গত নয়।



মন্তব্য:-

কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই কমিশনের সুপারিশে শিক্ষার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। হান্টার কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যেমন গুরুত্ব দিয়েছিল, তেমনি শিক্ষায় বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষাকে আনয়নের চেষ্টা করেছিল। তখন ওই শিক্ষা বিশেষ সফলতা না পেলেও আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই আমরা বলতে পারি যে, ভারতের শিক্ষা উন্নয়নে হান্টার কমিশনের অবদান আজকের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও প্রতীয়মান।



Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.