ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলােচনা করাে।
ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলােচনা করাে।
ইউরােপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান:
সূচনা: জার্মানি তথা ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬ খ্রি.)। তিনিই প্রথম খ্রিস্টান চার্চ ও পােপতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের সূচনা ঘটান। লুথারের ধর্মতত্ত্বের মূল কথা হল ঈশ্বরে অবিচল বিশ্বাসই মুখ্য, চার্চের আচার-আচরণ গৌণ ব্যাপার।
ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে যাজক টেটজেল রোমের ‘সেন্ট পিটার্স গির্জা’ সংস্কারের নামে অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এর জন্য তিনি জার্মানির স্যাক্সনিতে ইনডালজেন্স বা মার্জনাপত্র নামে পাপমুক্তির ছাড়পত্র বিক্রি করতে শুরু করেন। লুথার এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি তৎকালীন রীতি মেনে উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ৯৫ দফা অভিযোগ সংবলিত এক প্রতিবাদপত্র টাঙিয়ে দেন। লুথার প্রচার করেন—“মানুষ তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে অনুতাপের মাধ্যমে, পোপের কাছ থেকে মার্জনাপত্র কিনে পাপমোচন করা যায় না।”
প্রতিবাদী খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা
সেই যুগের অনাচার ও ভ্রষ্টাচারে ডুবে থাকা ক্যাথলিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যমে লুথার তাঁর মতবাদ প্রচার করেন। তাই তাঁর মতবাদ ‘প্রতিবাদী খ্রিস্টধর্ম’ বা ‘প্রোটেস্ট্যান্টবাদ’ নামে পরিচিত। তিনি ‘ব্যাবিলনীয় দাসত্ব’ ও ‘জার্মানজাতির খ্রিস্টান অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন’ নামে দুটি গ্রন্থে পোপের প্রাধান্য, যাজকদের ঈশ্বর কর্তৃক নিযুক্তি এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠানে যাজকদের প্রাধান্য অস্বীকার করেন।
পোপের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
লুথার পোপ ও গির্জার প্রতি তীব্র জেহাদ ঘোষণা করেন। বাইবেলের ব্যাখ্যাকার পোপের চূড়ান্ত কর্তৃত্বকে লুথার চ্যালেঞ্জ জানান। তাছাড়া তিনি পোপ কর্তৃক ধর্মীয়কর সংগ্রহেরও বিরোধিতা করেন। এর ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে পোপ দশম লিও লুথারকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দেন। লুথারকে ধর্মাধিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করে পোপ তাঁর কাছে এক আদেশনামাও পাঠান। কিন্তু লুথার পোপের সেই আদেশনামা জনসমক্ষে পুড়িয়ে দেন।
ওয়ার্মসের সভায় মতপ্রকাশ
পোপের ইচ্ছানুসারে জার্মান সম্রাট পঞ্চম চার্লস জার্মানির ওয়ার্মস শহরে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল এক ধর্মীয় আলোচনাসভার আয়োজন করেন। এই সভা ওয়ার্মসের সভা নামে পরিচিত। এই ধর্মসভায় সকল প্রতিনিধির সামনে লুথার নিজের মতকে অভ্রান্ত বলে ঘোষণা করেন। এই ধর্মসভায় লুথারের আচরণে ক্ষিপ্ত হয়ে পোপ লুথারকে পুড়িয়ে মারার ও তাঁর রচিত সব পুস্তক পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু জার্মান সামন্ত রাজা ফ্রেডারিক লুথারকে আশ্রয় দিলে পোপের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।
লুথারের জনসমর্থন
ইতিমধ্যে ক্যাথলিক ধর্ম ত্যাগ করে বহু জার্মান সামন্ত রাজা ও সাধারণ মানুষ লুথারের অনুগামী ও সমর্থকে পরিণত হয়।জার্মানির প্রাশিয়া, স্যাক্সনি, ব্রান্ডেনবার্গ, হেসে, লুক্সেমবার্গপ্রভৃতি অঞ্চলে লুথারের মতবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে।এই পরিস্থিতিতে লুথার ও পোপকে সমর্থনের প্রশ্নে জার্মানিতে গহযুদ্ধ শুরু হয়।এই গৃহযুদ্ধ চলাকালেই ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি লুথারের মৃত্যু হয়।
উপসংহার :- বহু চেষ্টা সত্ত্বেও লুথারকে হত্যা করা বা তাঁর মতাদর্শকে মুছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ লুথারের মতবাদকে সাধারণ জার্মানবাসী থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শাসকগণ পর্যন্ত সকলেই সমর্থন করেছিলেন। লুথার পোপের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলে খ্রিস্টীয় জগৎ ক্যাথলিক (পোপের সমর্থক) এবং প্রোটেস্ট্যান্ট (লুথারের সমর্থক) এই দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment