জাতীয়তাবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি নির্দেশ কর
জাতীয়তাবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি নির্দেশ করো।
জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মূল যুক্তি
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাঁদের তাত্ত্বিক আলোচনায় জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক দিকগুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা নিম্নে আলোচিত হল-
(i) একটি মহান আদর্শ
জাতীয়তাবাদকে জাতীয় জীবনের এক মহান আদর্শ ও একটি গভীর অনুপ্রেরণা হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতেও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রতিটি জাতি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের মানবসভ্যতার দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
(ii) পরাধীন জাতির কাছে মুক্তির অগ্রদূত
জাতীয়তাবাদ পরাধীন জাতিসমূহের কাছে মুক্তির অগ্রদূত রূপে পরিচিত। কারণ জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনের আপ্রাণ সংগ্রাম চালায়। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যে মুক্তিসংগ্রাম চলেছিল তার উৎস যে উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
©shikshakuthir
(iii) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক
জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক। জাতীয়তাবাদের আদর্শ কালক্রমে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার আদর্শের জন্মদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিভিন্ন জাতিকে নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে, অপরদিকে তাদের গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে।
(iv) মানবসভ্যতার অগ্রগতির সূচক
জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার বিকাশের সহায়ক, কারণ এর মাধ্যমেই পরাধীন জাতির মুক্তির মন্ত্র ধ্বনিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতীয়তাবাদই তৃতীয় বিশ্বের (উদাহরণস্বরূপ- এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া, লিবিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি) জাতিগুলিকে নতুন চেতনা ও শক্তিতে উদ্বুদ্ধ করে মানবসভ্যতার উন্নতিতে সাহায্য করেছে।
©shikshakuthir
(v) সুশাসান সহায়ক
জাতীয়তাবাদ দেশের শাসনব্যবস্থাকে স্থায়ী, স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তোলে। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার ফলে দেশে শাসক-শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বলেই আইনের নির্দেশ ও আইন মান্য করার মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
(vi) জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক
জাতীয়তাবাদের প্রচারকেরা জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী হিসেবে দেখেন না, তারা জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক হিসেবে দেখেন। জাতিসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা, আন্তর্জাতিক আইন ও সংগঠনের প্রতি আস্থা আন্তর্জাতিকতার লক্ষ্যকেই সফল করে।
জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি
জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল-
[1] জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয়
অভ্যন্তরীণ এমনকি বাহ্যিক প্রকৃতিতে অসহিষ্ণুতা, সন্দেহ, হিংসা ও বিরোধ জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস সাক্ষী যে, জাতির সংকীর্ণতা থেকে উগ্রতা এবং আধিপত্যের মনোভাব এসেছে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, হিংসা ও হানাহানির সৃষ্টি হয়েছে।
[2] অন্যায় ও অমঙ্গালর উৎস
জাতীয়তাবাদের দুটি রূপের মধ্যে অন্যতম একটি রূপ হল বিকৃত জাতীয়তাবাদ। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেজ মন্তব্য করেছেন, জাতীয়তাবোধ, জাতীয় রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমের সংমিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটেছে তা চরম অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎসস্থল।
[3] গণতান্তর বিরোধী
উগ্র জাতীয়তাবাদ জনমতকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে। এর ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়। বিভাজন সৃষ্টির এই প্রচেষ্টা সমতার নীতিকে অগ্রাহ্য করে। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) বলেন, জাতীয়তাবাদের আড়ালে ব্যক্তির স্বতন্ত্র অবস্থান ও চেতনাকে অধীনে এনে রাজনৈতিক নেতারা জনসাধারণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করেন।
[4] সাম্রাজ্যবাদের জন্মদাতা
উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে হেয় করে তাদের উপর প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম হয়। যেমন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার জার্মান জাতিকে উগ্র ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে তার সাম্রাজ্যবাদী নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন।
[5] সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকট
সংকীর্ণ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক। এর কারণ স্বাধীনতা বা মানবতা নয়, এই জাতীয়তাবাদ ক্ষমতা ও অর্থের লড়াইয়ের সৃষ্টি করে। এইরূপ জাতীয়তাবাদের নীতি হল- অন্য জাতির সংস্কৃতিকে দমন করা এবং শুধুমাত্র নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা।
[6] বিশ্বশান্তি বিঘ্নকারী
জাতীয়তাবাদের উগ্ররূপ যুদ্ধবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বিশ্বশান্তি বিঘ্নকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এরা ন্যায়-অন্যায়, আলাপ-আলোচনা প্রভৃতিকে অবজ্ঞা করে যুদ্ধকে একমাত্র পথ হিসেবে গণ্য করে।
©shikshakuthir
Comments
Post a Comment