আইন-ই-আকবরী

 আইন-ই-আকবরী  মুগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) দরবারের ঐতিহাসিক আবুল ফজল কর্তৃক রচিত আকবরনামা গ্রন্থের তৃতীয় খন্ড। আকবরনামা একটি ইতিহাস গ্রন্থ। সুষ্ঠু প্রশাসন প্রবর্তন ও কার্যকর করার জন্য সম্রাট আকবর যে আইন ও নীতি প্রবর্তন করেন তা আইন-ই-আকবরীতে উল্লিলখিত হয়েছে। এটি একটি প্রবিধানপূর্ণ প্রশাসনিক সারগ্রন্থহ এবং একটি আধুনিক গেজেটিয়ার এর সমতুল্য।

আকবরনামার অংশবিশেষ হলেও আইন-ই-আকবরী এককভাবেই এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। আইন-ই-আকবরীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সম্রাট আকবরের সরকার ব্যবস্থা, এর বহুবিধ প্রশাসনিক বিভাগ, বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ প্রভৃতি। ভারতবর্ষে মুসলিম আমলে লিখিত সকল ইতিহাসই ছিল ধারাবিবরণীমূলক। এগুলি ছিলো মুখ্যত কালক্রমানুসারে যুদ্ধ, বিজয় এবং বংশের উত্থান-পতনের বিবরণে পূর্ণ। দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ব্যাপক মৃত্যু ছাড়া সাধারণ জনগণ এ সকল বিবরণে কখনো স্থান পায় নি। কিন্তু আইন-ই-আকবরী এক ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। এ গ্রন্থে রাজকীয় স্থাপনা, সাম্রাজ্যের অভিজাত ও উচ্চপদস্থ অমাত্যবর্গের বর্ণনা ছাড়াও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সাধারণ মানুষ ও কর্মচারীদেরও বিবরণ বিধৃত হয়েছে। এমন কি রাজকীয় হারেম, রন্ধনশালা এবং বাসনকোসন, সুগন্ধি, ঘোড়া, হাতি প্রভৃতি পশু, এবং বসন্ত ও হেমন্তকালীন শস্য ও শাকসবজি সহ যাবতীয় বিষয় এতে আলোচিত হয়েছে। আবুল ফজল এ গ্রন্থে হিন্দু, মুসলিম, জৈন ও অন্যান্য সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের সামাজিক অবস্থা, সাহিত্য কর্ম, প্রচলিত আইন এবং দর্শন চিন্তাও আলোচনায় আনেন। তদুপরি এখানে খ্যাতিমান পরিব্রাজক, মুসলিম আউলিয়া, দরবেশ ও সুফিদের ওপর পৃথক পৃথক অধ্যায় সংযোজিত আছে।

আইন-ই-আকবরীতে উল্লিখিত তথ্যসমূহ বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো তিন ভাগে বর্ণিত সুবাহ বাংলার বিবরণ যার প্রথম ভাগে সুবার ইতিহাস ও ভৌগোলিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে ১৯টি সরকারে বিভক্ত বাংলার প্রতিটি সরকারের কৃষি ও শিল্প উৎপাদন এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের আলোচনা এবং তৃতীয় ভাগে বর্ণিত হয়েছে প্রদেশে কর আরোপের বিবরণ। এ থেকে প্রথমবারের মতো জানা যায় যে, বাংলা সুবা ১৯টি সরকারে এবং প্রতিটি সরকার অনেকগুলি মহল বা পরগণায় বিভক্ত ছিল এবং মোট ধার্য করের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকারও বেশি।

আইন-ই-আকবরীর আরেকটি তাৎপর্যতম অধ্যায় হল মুগল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সমীক্ষা এবং বাংলাসহ প্রতিটি প্রদেশের পরিসংখ্যানগত বিবরণ। কার্যত আইন-ই-আকবরী হল মুগল সাম্রাজ্যের সরকার ব্যবস্থায় প্রশাসনিক নিয়মনীতি এবং আন্তঃবিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তথ্যপূর্ণ বিবরণী। পরবর্তী মুগল শাসকদের নিকট গ্রন্থটি ছিল প্রশাসন এবং রাজস্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে পথনির্দেশক মূলক। আধুনিকালেও মুগলদের রাজস্ব বিভাগীয় পরিভাষা এবং প্রশাসনিক আইন-কানুন এখনো প্রায় ওই রকমই টিকে আছে। অবশ্য প্রাচীন ও প্রাক্-মুগল যুগের শাসকদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং বাংলা প্রদেশসহ বিভিন্ন সুবার ঘটনাবলির বিবরণ যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। তবে এ গ্রন্থে বিধৃত ভৌগোলিক ও সাংস্থানিক বিবরণ সন্তোষজনক বলেই বিবেচিত হয়। ভারতীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী  এক অপরিহার্য উপাদান

Comments

Popular posts from this blog

ডেভিড স্টনের ব্যবস্থাপক তত্ত্বটি সংক্ষেপে আলোচনা কর।

Write down the techniques for effective reading and the reading strategies that are useful.

প্রাচীন অনুবর্তনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাচীন অনুবর্তন প্রতিক্রিয়ার ব্যবহার লেখো।Nature/Characteristics of Classical Conditioning . Educational implications of Classical Conditioning.